করোনা সংক্রমণ থেকে রেহাই পেতে বিষাক্ত জৈবতরল মিথানল পান করেই কাল হল তাদের
সম্প্রতি ইরানে মিথাইল অ্যালকোহল নামক বিষাক্ত তরল পান করে জীবনহানি হল প্রায় তিনশো জনের। উচ্চমানের অ্যালকোহল নাকি করোনাভাইরাস নিরাময়ের মহৌষধ। দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া উক্ত গুজবের জেরেই অবশেষে এই করুণ পরিণতি ডেকে আনে জনমানসে।
ইরানের মিডিয়ার রিপোড়, যেখানে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র সারা ইরানজুড়ে মদ্যপান কঠোরভাবে নিষিদ্ধ সেখানে বে-আইনীভাবে বুটলেগারদের সাহায্যে বিষাক্ত মিথানল আকন্ঠ পান করেছে প্রায় হাজারের মত ইরানি সাধারণ মানুষ।
ঘটনাটি সামনে আসে যখন গত শুক্রবার তেহরান করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে ১৪৪ জন নতুন মৃত্যুর ঘোষণা দেয়। এনিয়ে ইরানে মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াল ২৩৭৪ এবং অন্যদিকে ২৯২৬ টি নতুন সংক্রমণের জেরে সারাদেশে মোট করোনাভাইরাস সংক্রমণ সংখ্যা দাঁড়াল ৩২,৩০০ এ।
সংক্রমণ প্রতিকার বিষয়ে ইরানে সোশ্যাল মিডিয়ায় বহুলভাবে ছড়িয়ে পড়া ওই ভুঁয়ো তথ্যের দরুন জনগণ সরকারের প্রতি গভীর ধন্ধে পড়ে যায় যে, ইরান সরকার করোনায় আচ্ছন্ন সারাদেশের অবস্থার প্রতি ভ্রুক্ষেপহীন এবং করোনা মোকাবিলায় উপযুক্ত পদক্ষেপ না নিয়ে ধীরে চলো নীতি নিয়েছে যা শঙ্কিত করে সাধারণ জনগণকে।
ডঃ নুট ইরিক হোভদা, অসলো ক্লিনিকালের বিশিষ্ট টক্সিকোলজিস্ট যিনি মিথানলের বিষাক্ততার ব্যাপারে ইঙ্গিত দেন এবং শঙ্কা প্রকাশ করেন যে ইরানের প্রাদুর্ভাব আরও খারাপ হতে পারে। তিনি বলেন, “দেশে ভাইরাস সংক্রমণ ক্রমশ বাড়ছে এবং মৃতের তালিকা আরও বাড়বে এবং আমি মনে করি এমনকি দেশের মধ্যে অন্য বিপদও অপেক্ষা করছে”
তিনি আরও বলেন, “লোকেরা যেহেতু পানীয়টি পান করেই যাচ্ছে, তাই আরও অধিক সংখ্যক মানুষ বিষের প্রকোপে পতিত হতে চলেছে।”
দেশজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারী ইরানের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতাকে গুরুতরভাবে আঘাত হেনেছে। প্রায় আশি মিলিয়ন মানুষ বাড়িতে সেল্ফ-আইসোলেশনে দিন কাটাচ্ছে।
এখনো পর্যন্ত, কোভিড-১৯ সংক্রমণের জন্য কোন পরিচিত ওষুধ আবিস্কৃত হয়নি। বিজ্ঞানীরা এবং ডাক্তাররা এই মারণ ভাইরাসটির বিষয়ে নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং কার্যকরী ওষুধ এবং ভ্যাকসিনের অনুসন্ধান করে চলেছেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ইরানের সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে ফারসি ভাষায় ভুয়ো পরামর্শ নিরন্তর গতিতে একের পর এক ছড়িয়ে পড়ছে যা দেশটির শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্বকে চিন্তায় ফেলেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে ট্যাবলয়েড স্টোরি থেকে একটি গুজব রটে যে, একটি ব্রিটিশ স্কুলের শিক্ষক ও অন্যান্যরা নাকি হুইস্কি ও মধু পান করে করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে আরোগ্যলাভ করেছে!
অ্যালকোহলভিত্তিক হ্যান্ড স্যানিটাইজারগুলির ব্যবহার সম্পর্কে গুজব বার্তাগুলির কু-প্রভাবে জনমানসে ভুল বিশ্বাসের জন্ম দেয় যে, হাই-প্রুফ অ্যালকোহল পান করলে নাকি দেহে সংক্রমিত ভাইরাসটিকে মেরে ফেলা যাবে।
ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ইরান নিশ্চিত করেছে, কোভিড-১৯ দ্বারা ২৯,০০০ এরও বেশি মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন এবং এ পর্যন্ত ২২০০ এরও বেশি মৃত্যুবরণ করেছেন।
আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরাও আশঙ্কা করছেন যে, সামনে ইরানে সংসদ নির্বাচন থাকায় ভাইরাস সংক্রমণে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ইরান কর্মকর্তারা ইচ্ছে করেই কম প্রকাশ করছে।
ভাইরাসটির প্রতি অহেতুক ভীতি, শিক্ষার অভাব এবং ইন্টারনেট গুজব সহ, ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় খুজেস্তান প্রদেশ এবং এর দক্ষিণ শহর শিরাজ শহরে বেআইনীভাবে অ্যালকোহল পান করে বেশ কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ইরান মিডিয়া কারাজ ও ইয়াজড শহরেরর ব্যাপারেও রিপোর্ট প্রকাশ করেছে।
সরকার আরও জানিয়েছে যে, বিষাক্ত মিথানল নির্মাতারা তাদের পণ্যে একটি কৃত্রিম রঙ যোগ করেছেন যাতে জনগণ এটি ইথানল থেকে পৃথক ভাবতে পারে, এমন একটি অ্যালকোহল যা কি-না সংক্রমিতদের নিরাময় দিতে পারে!
অপরদিকে ইথানল যদিও পানের যোগ্য, তবুও তার উৎপাদন ইরানে অবৈধ। ইরানের কিছু বুটলেগার বে-আইনীভাবে মিথানল ব্যবহার করে এবং পানীয় হিসেবে বাজারে বিক্রির পূর্বে এর সাথে ব্লিচ ছিটিয়ে রঙের ভাবকে গোপন করে।
মিথানল স্নায়ুতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর এবং এর অত্যধিক উপস্থিতির কারণে অন্ধত্ব, পঙ্গুত্ব, মৃত্যু হতে পারে। মানুষের শরীরের পক্ষে মিথানল খুবই বিষাক্ত।তবে মিথানলের খুব সামান্য উপস্থিতি মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়।
ডাঃ জাভাদ আমিনি সামান বলেন, ‘এটা ব্যাপক গুজব যে অ্যালকোহল ধৌতকরণে ব্যবহৃত হতে পারে এবং পাচনক্রিয়াকে স্যানিটাইজ করবে। এটা মারাত্মকরকমের একটা ভুল।’
করোনা প্রাদুর্ভাবের পূর্বেও, মিথানল পানে বিষক্রিয়া ইরানে একটি হুজুগ উঠেছিল। এক একাডেমিক গবেষণায় দেখা গেছে, কেবল গত ২০১৮ সনের সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরের মধ্যেই মিথানলের বিষক্রিয়ায় স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে পতিত হয় প্রায় ৭৬৮ জন মানুষ এবং মৃত্যুবরণ করে প্রায় ৭৬ জন!
মিথানলের বিষাক্ততা লক্ষ্য করে অন্য মুসলিম দেশগুলো অবশ্য সংশ্লিষ্ট দেশে এই মারণ অ্যালকোহল পান নিষিদ্ধ করেছে।
বৌদ্ধ অধ্যুষিত কম্বোডিয়ার পুলিশ জানায়, তারা এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে যে কি-না ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের এই দুর্দিনে অজ্ঞাতসারে ৪২০০ লিটার (১১০০ গ্যালন) মিথানল নিয়ে বিষাক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার প্রস্তুতিতে নেমেছিল।
ইরানে মদ্যপানের শাস্তি হিসেবে মুসলিমরা নগদ জরিমানাসহ এবং ৮০ কশাঘাতপ্রাপ্ত হয়। অন্যদিকে, সংখ্যালঘু খ্রিস্টান, ইহুদি এবং জরাথুষ্ট্রীরা অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে মদ্যপান করতে পারেন।