ছোট্ট রবির কবি গাঁথা
লিপিকা সোম
আমাদের ছিল এক অনেক কালের খাজাঞ্চি,
বিখ্যাত সেই আত্মীয়ের নাম – কৈলাস মুখুজ্জি।
লোকটি ছিল বড়ই মজার, মৃত্যুর পরেও কমেনি তার কৌতুকের বাহার।
প্ল্যানচেট যোগে পরলোকের সাথে চেষ্টায় গুরুজনাদি –
“তুমি যেখানে আছো
সেখানকার ব্যবস্থাটা কিরূপ
বল দেখি।”
শুধায় কৈলাস মুখুজ্জি –
“আমি মরে যা জেনেছি
আপনারা বেঁচে থেকেই
ফাঁকি দিয়ে জানতে চান নাকি?”
দাদাও আমার বয়োজ্যেষ্ঠ ভাগ্নে সত্য,
স্কুলে যেতে দুজনের তোড়জোড় চলত।
স্কুলে যেতে আমারও উচ্চৈঃস্বর রোদন,
‘ওরিয়েন্টাল সেমিনারি’– তে জুড়ল আমার বন্ধন।
এমনি করে নিতান্ত শৈশবে আমার পড়া আরম্ভ,
চাকরদের মহলেই হল চানক্য শ্লোকের প্রারম্ভ।
আমার মায়ের ছিল কোন এক খুড়ি,
কোন ছেঁড়া কৃত্তিবাসী রামায়ণ পড়তেন তিনি।
দখল করলাম সেই মার্বেলী মলাট রঙিন বই খানি।
শিশু কালে ছিল ,
না কোনো ভোগ বিলাসিতা,
চাকরদেরই অধীন ছিলাম, ছিলনা স্বাধীনতা।
খাবারের গন্ধেও ছিলনা বিন্দুমাত্র শৌখিনতা,
তালিকা ধরলে আছে সম্মান হানির আশঙ্কা।
শীতের দিনেও যথেষ্ট ছিল একটি সাদা
জামার উপর আরেকটি মাত্র জামা।
পকেটও জুড়তেন না আমাদের নেয়ামত খলিফা দর্জি,
যদি রাখবার মতো ছিল কমবেশি সম্পত্তি।
আমাদের চটি জুতো একজোড়া থাকত বটে,
তাতে সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই ব্যর্থ হত পদেপদে।
উত্তর কোনের ঢেঁকি ঘরে মিটত গৃহঃস্থালির কাজ,
কলকাতায় পল্লী জীবনের আন্তরিকতা বিরাজ।
বাড়ির উত্তর – অংশে একচিলতে গোলা বাড়ি,
ছুটির দিনে সেথায় কল্পনার পাখনা মেলি।
সন্ধ্যাকালে শিক্ষক করতেন রামায়ণ – মহাভারত পাঠ,
কিশোর চাটুজ্যে পাঁচালি গেয়ে পুরিতেন তার ফাঁক।
ঈশ্বর( চাকর) এর আফিমে ছিল আকর্ষণ,
আমার বরাদ্দকৃত দুধে মিটত তার প্রয়োজন।
বরাদ্দের জল-খাবারের পয়সাও করত চুরি,
রাশি রাশি লুচি উদরে পুরতে ছিলনা তার জুড়ি।
বয়স যখন সাত – আট এর ঘরে,
ভাগ্নে জ্যোতিঃপ্রকাশ বলল – “তোমাকে পদ্য লিখতে হবে।”
শেখাল নিজেই পয়ার ছন্দ আর চৌদ্দ অক্ষর রীতি,
পদ্য রচনার মহিমা সম্পর্কে কাটল আমার ভীতি।
কর্মচারীর কৃপায় জুটল নীল কাগজের খাতা,
কাঁচা অক্ষরে অসমান লাইনে ভরালাম তার পাতা।
দাদা ও দুই ভাই ঘোষণা করল আমার কবিত্ব ,
জুটল ন্যাশনাল এর এডিটর শ্রীযুক্ত নব গোপাল মিত্র।
সকাল ৬ – ৯ চলত চারুপাঠ, বস্তু বিচার ও প্রাণী বৃত্তান্ত
বড়োই দুর্বোধ্য ছিল মাইকেলের মেঘনাদবধ কাব্য।
ভোরের অন্ধকারে চলত কানা পালোয়ানের সাথে কুস্তি,
মাটি মাখা শরীরেই চলত – ইতিহাস, ভূগোল, গনিত ও জ্যামিতি।
স্কুল থেকে ফিরলেই আসত ড্রয়িং ও জিমন্যাস্টিকের মাস্টার,
আমাদের দম ফেলারও মিলতনা অবসর।
সন্ধ্যায় আসতেন ইংরেজির অঘোরবাবু
টিমটিমে বাতির গোড়ায় হতাম মোরা কাবু।
রবিবার সকালে চলত বিষ্ণুর কাছে সংগীতচর্চা,
সীতানাথ দত্তের কাছে হত প্রকৃতি বিজ্ঞান শিক্ষা।
অস্থি বিদ্যা শেখাতেন ক্যাম্পবেল মেডিকেলের এক ছাত্র
হেরম্ব তত্ত্বরত্ন পড়াতেন মুকুন্দং সচ্চিদানন্দং এবং বোপ দেবের সূত্র।
বাংলা শিক্ষার যখন বহুদূর প্রসারণ,
তখনই বসল ইংরেজি শিক্ষার আসর।
একবার কলকাতায় জুটল ডেঙ্গু জ্বরের তাড়না,
পেনেটিতে ছাতুবাবুর বাগানে আশ্রয়ের ভাবনা।
তখনই প্রথমবার আমার বাইরে যাত্রার ঘটনা।
গঙ্গার তীর ভূমি আর পেয়ারা গাছের ছায়া,
নৌকার গতি ভঙ্গি আর জোয়ার ভাঁটার আসা যাওয়া,
খিড়কির পুকুর, এখোগুড় আর বাসি লুচি,
নয়ন জুড়ে বসল পুষ্পিত এক ঘড় চাঁপার ডালি।
সব শেষে ফেরা হল জোড়াসাঁকোর বাড়ি।
নীল খাতাটি ভরে উঠল আঁকা বাঁকা লাইনে,
আগ্রহপূর্ণ বালকের চঞ্চল হাতের পীড়নে।
সাতকড়িমহাশয়, শ্রীকন্ঠবাবু ও গোবিন্দবাবু বেটে খাটো,
তাদেরই স্নেহে আমার কবিতা সুললিত
তথ্যসূত্র : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জীবনস্মৃতি