ঈশ্বর
মহিবুল আলম
।। উনিশ ।।
তৃতীয় পুরুষের গল্পটা তেমন দীর্ঘ নয়। নারী গল্পের বেশিরভাগ আগে থেকেই জানত। তবে সে আজ আরও বেশি করে জানল। তৃতীয় পুরুষ খুব অল্পবয়সে বিয়ে করেন। তখনো তিনি চলচ্চিত্রজগতে পা দেননি। বিএ পরীক্ষা দিয়ে থিয়েটারে যখন কাজ শুরু করেন, ঠিক তখনই অন্য আরেক থিয়েটার কর্মীর প্রেমে পড়েন। প্রেম একসময় শারীরিক সম্পর্কে গড়ায়। ওরা একদিন কাজী অফিসে গিয়ে বেলিফুলের মালা বদল করে বিয়েটা সেরে ফেলেন।
তৃতীয় পুরুষের স্ত্রীর নাম ছিল এলিজা রহমান।
পারিবারিক সম্মতি বাদে বিয়ে করাতে তৃতীয় পুরুষ ও তার স্ত্রী এলিজা উভয়ই যার যার পরিবার থেকে বিতাড়িত হন। কিন্তু ওরা হাল ছাড়েননি। সেই সত্তর দশকের শেষের দিকের ঘটনা। তখন ঢাকা শহরে বাসা ভাড়া অত ছিল না। ওরা হাতিরপুল ভুতের গলির কাছে একটা এক রুমের বাসা ভাড়া নেন। তৃতীয় পুরুষ থিয়েটারে কাজ করার পাশাপাশি দুটো টিউশনি করতে শুরু করেন। আর ওদিকে এলিজা রহমান অভিনয় ছেড়ে দিয়ে একটা এনজিওতে চাকুরি নেন।
ওদের ছোট্ট সংসার, কিন্তু সুখের কমতি ছিল না। দুই বছরের মাথায় তাদের একটা মেয়ে হয়। তৃতীয় পুরুষ মেয়ের নাম রাখেন- আনমনা। কিন্তু এলিজা রহমানের ‘আনমনা’ নামটা তেমন পছন্দ নয়। তাই সে মেয়ের নাম রাখে- হৃদি। তৃতীয় পুরুষ শেষপর্যন্ত ওই নামটাই মেনে নেয়।
আশির দশকে তৃতীয় পুরুষ টেলিভিশনের নাটকে তেমন সুযোগ না পেয়ে চলচ্চিত্রজগতে পা রাখেন। কয়েকবছর যেতেই চলচ্চিত্রে রূপকথার রাজপুত্র সেজে দর্শকদের অনেকগুলো হিট সিনেমা উপহার দেন। আর ওদিকে তার জীবনেও জৌলুস-প্রতিপত্তি এসে ভিড় করে। তিনি মিরপুরে আটকাঠা জায়গার ওপর বেশ বড়সড় দোতলা বাড়ি করেন। ততদিন পর্যন্ত ওদের সুখের কোনো অন্ত নেই। মেয়েটা আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। এলিজা রহমানও চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোদস্তুর গৃহিণী হয়ে ওঠে।
কিন্তু আশি দশকের শেষের দিকে তৃতীয় পুরুষ যে স্ত্রীকে বেলিফুলের মালা পরিয়ে বিয়ে করেছিলেন, সেই স্ত্রীকে অবহেলা করে তিনি এক নায়িকার প্রেমে পড়েন। নায়িকার নাম- সুজানা বকশি।
সেই সুজানা বকশিও তৃতীয় পুরুষের প্রেমে হাবুডুবু খেতে শুরু করে।
সুজানার অভিনয়ের দক্ষতা অবশ্য তৃতীয় পুরুষের চেয়ে ভালো ছিল। সে টিভি নাটক করতে করতে একসময় চলচ্চিত্রে পা দিয়েছিল। ওরা দুজন মাত্র একটা সিনেমা করেই কাছাকাছি চলে আসে। কাছাকাছি থেকে প্রেম। ক্রমে ওদের প্রেম গভীর থেকে গভীরতর হয়। ওরা গোপনে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে বসবাস করতে শুরু করে। এরই মধ্যে সুজানা বকশি প্রেগন্যান্ট হয়ে যায়।
তৃতীয় পুরুষ সুজানা বকশিকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়।
কিন্তু বিয়ের কথা উঠতেই সুজানা বকশি শর্ত দেয়, তৃতীয় পুরুষ যদি তার প্রথম স্ত্রীকে তালাক না দেয়, তাহলে সে বিয়ে করবে না। পেটের বাচ্চাটা নষ্ট করে ফেলবে।
তৃতীয় পুরুষ সুজানা বকশির প্রেমের এতই মোহগ্রস্থ হয়ে পড়েন যে তিনি তাই করেন। তিনি তার প্রথম স্ত্রী এলিজা রহমানকে তালাক দেন।
ওদিকে এলিজা রহমান দুঃখে-কষ্টে ও মানসিক যন্ত্রণায় মেয়ে হৃদিকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যায়। তার বাবার বাড়ির লোকজন পুরান ঢাকার বেশ প্রভাবশালী ছিল। ওরা তৃতীয় পুরুষকে কোর্টে তোলে।
একবছরের কোর্টকাচারির পর তৃতীয় পুরুষ তার অর্ধেক সম্পত্তি এলিজা রহমান ও তার মেয়েকে দিয়ে সুজানা বকশির সঙ্গে নতুন সংসার পাতেন। এরই মধ্যে অবশ্য সুজানা বকশির পেটের বাচ্চাটা আপনা থেকেই নষ্ট হয়ে যায়। অবশ্য তখন এমনও গুঞ্জন উঠেছিল, সুজানা নিজ থেকেই নাকি ওষুধ খেয়ে বাচ্চাটা নষ্ট করে ফেলেছে। মিরপুরের একই বাড়িতে তৃতীয় পুরুষের নতুন সংসার শুরু হয়। প্রথম চার বছর ওদের সংসার সুখেরই ছিল। কিন্তু পাঁচ বছরের মাথায় ওদের সম্পর্কের ভাঙন ধরে। এরই মধ্যে তৃতীয় পুরুষের চলচ্চিত্রের ক্যারিয়ারে ধস নামে। নব্বই দশকের প্রথম থেকেই রূপকথার রাজাবাদশাদের সিনেমা বানানোর পড়তি শুরু হয়। নব্বই দশকের মাঝামাঝি এসে ওসব সিনেমা বানানো প্রায় বন্ধই হয়ে যায়। এছাড়া তিনি নিজের প্রযোজনায় একটা সিনেমা বানাতে গিয়ে প্রায় দেউলিয়া হতে বসেন।
ওদিকে তৃতীয় পুরুষের দ্বিতীয় স্ত্রী সুজানা বকশি বাংলাদেশের সিনেমার মন্দা দেখে আবার নাটকের জগতে ফিরে আসে। তখন টেলিভিশনে প্যাকেজ নাটকের ধূম। সে তার চেয়ে অল্পবয়সী এক নাট্যপরিচালকের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। এক সময় সে তৃতীয় পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কের ইতি ঘটিয়ে সেই অল্পবয়সী নাট্যপরিচালকের সঙ্গে বসবাস শুরু করে। পরে বিয়েও করে।
কিন্তু তৃতীয় পুরুষ আবার কোর্টকাচারি সামলে, সম্পত্তি যা ছিল তার অর্ধেক দ্বিতীয় স্ত্রীকে দিয়ে প্রায় নিঃস্ব হয়ে নব্বই দশকের শেষের দিকে আমেরিকার দিকে পা বাড়ান। তার আমেরিকা যাওয়ার পেছনে আরেকটা কারণও ছিল। তার প্রথম স্ত্রী এলিজা রহমান ও কন্যা হৃদি তখন আমেরিকা বসবাস করছে। তিনি ভেবেছিলেন, সেখানে গিয়ে তিনি প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে আবার নতুন করে সংসার পাতবেন।
কিন্তু এলিজা রহমান তৃতীয় পুরুষের সঙ্গে নতুন করে সংসার থাক দূরের কথা তাকে তার মেয়ের কাছেই ভিড়তে দেয়নি।
তৃতীয় পুরুষ পুরো দশটা বছর আমেরিকায় থেকে প্রথম স্ত্রী ও মেয়ের সান্নিধ্য না পেয়ে একসময় বাংলাদেশ ফিরে আসেন। অবশ্য তিনি অন্য আরেকটা কারণেও আমেরিকা ছাড়তে বাধ্য হন। তার কাছে আমেরিকায় বসবাসের বৈধ কোনো কাগজপত্র ছিল না। বাংলাদেশে এসে তিনি আবার নতুন করে জীবন শুরু করেন। তার এ জীবন অনেকটা একাকী জীবন। আজকাল অবশ্য মাঝেমধ্যে মেয়েটা ফোন দেয়। কিন্তু তার প্রথম স্ত্রী এলিজা রহমান অভিমানে ও কষ্টে তার দিকে কখনো ফিরেও তাকায়নি।