ঈশ্বর
মহিবুল আলম
।। আঠারো ।।
তৃতীয় পুরুষ দরজায় কার সঙ্গে কথা বলে ব্যালকনিতে আবার ফিরে এলেন। পূর্বের চেয়ারটায় বসতে বসতে বললেন, কাজের মহিলা এসেছিল। দেখ, এতক্ষণে এসেছে দুপুরের রান্না করতে।
নারী বলল, অ, এখন কি সে রান্না করবে?
– আরে না। এখন রান্না করলে আমরা কখন খাব? তারচেয়ে বরং আমরা যাত্রাবাড়ি গিয়ে একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে খেয়ে আসি। তুমি সপ্তাহে একদিন আসো। কোনো সপ্তাহে আসোই না। তোমাকে নিয়ে বাইরে না খেলে কি হয়? বাসার খাবার তো সবসময়ই খাই।
– খাবারদাবারটা ইম্পরট্যান্ট না। তোমার সঙ্গে সময় কাটাতে আসি, ওটাই আসল।
তৃতীয় পুরুষ আন্তরিক হাসলেন। তিনি কিছু বলতে যাবেন তার মোবাইলটা বেজে উঠল। তিনি নারীর চেহারা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মোবাইলে স্ক্রিনে তাকালেন। স্ক্রিনে নামটা দেখেই তার চেহারা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। বললেন, আরে, আমার মেয়ের ফোন। দাঁড়াও ধরে নিই।
নারী মৃদু হেসে সায় দিল।
তৃতীয় পুরুষের মেয়েটা ফোনের ওপাশ থেকে কী বলল, নারী তা বুঝতে পারল না। এপাশে তৃতীয় পুরুষের সংক্ষিপ্ত কথাটাই শুনল, জি মা, থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ। টেক কেয়ার। লাভ ইউ…!
তৃতীয় পুরুষ লাইন কেটে দিয়ে বললেন, আনমনা এখন ডিউটিতে আছে। নাইটশিফট করছে। তাই বেশিক্ষণ কথা বলতে পারেনি। আমাকে উইশ করার জন্য ফোন করেছিল।
নারী জিজ্ঞেস করল, এখন আমেরিকাতে রাত, তাই না?
তৃতীয় পুরুষ বললেন, হ্যাঁ।
– আচ্ছা, তুমি না তোমার মেয়ের নাম বলেছিলে হৃদি?
– হ্যাঁ, তবে ওটা তার মায়ের রাখা। আমি তার নাম রেখেছিলাম আনমনা। তবে সবাই তাকে হৃদি নামেই ডাকে। আনমনা নামে কেউ ডাকে না। আমিই শুধু ডাকি।
– কেন? আনমনা নামটা তো অনেক সুন্দর।
– আমি জানি। কিন্তু ওর মা…।
– অ, আচ্ছা, বুঝেছি। তবে সে তোমাকে কিসের জন্য উইশ করল?
– আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী যে?
– ওহো তাই, দারুণ তো! এ জন্য কি বিসমিল্লাহ খাঁর সানাই শুনছিলে?
তৃতীয় পুরুষ একটু লজ্জা পেয়ে হেসে ফেললেন। বললেন, হ্যাঁ।
নারী নিজে নিজে মৃদু হেসে বলল, তবে, তুমি বিসমিল্লাহ খাঁর সানাই শুনছো দেখে আমি খুব অবাক হয়েছি।
– কেন, আমার কি বিসমিল্লাহ খাঁর সানাই শুনতে নেই?
– না, তা বলছি না। তবে তুমি যেসব সিনেমার নায়ক ছিলে, বিসমিল্লাহ খাঁর সানাই তো তোমার সঙ্গে যায় না।
– ইন্সাল্ট করছ?
নারী ব্যস্ত হয়ে বলল, আরে না না। আমি তো এমনিই মজা করছিলাম। তুমি মনে কিছু নিও না। সরি।
তৃতীয় পুরুষ মৃদু হেসে বললেন, না না। আমি জানি, তুমি মজা করছ। তবে আমি যেসব সিনেমায় অভিনয় করতাম, সেসব রাজাবাদশাদের সিনেমায় কিন্তু বিসমিল্লাহ খাঁর সানাই বেশি ব্যবহার করা হতো। ওই যে, নায়কের সঙ্গে নায়িকার বিরহ, ব্যাকগ্রাউন্ডে করুণ সানাইর সুর- টো টোটো টো টো। রাজাকে খুন করা হয়েছে। রানিকে রাজমহল থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। রানি একেবারে খালি হাতে ছোট্ট রাজপুত্রকে নিয়ে রাজমহল থেকে বের হচ্ছে। সেই ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে বিসমিল্লাহ খাঁর সানাই- টো টোটো টো টো। রাজপুত্রকে সাপে কামড় দিয়েছে। রাজকন্যা বনে-বাদাড়ে সেই সাপটা খুঁজছে। আবার বিসমিল্লাহ খাঁর সানাই- টো টোটো টো টো। রাজমাতা রাজপুত্রকে ছোটবেলায় হারিয়ে ফেলেছিল। গলায় একটা ছবি সম্বলিত সোনার লকেট। সেই লকেটের মাধ্যমে রাজমাতা ও রাজপুত্রের আবার মিলন। মা-ছেলের সেই মিলনের সুরে বিসমিল্লাহ খাঁর সেই সানাই- টো টোটো টো টো…।
তৃতীয় পুরুষের কথায় নারী হাসি থামিয়ে রাখতে পারল না। হাসির দমকে সে হাত নাচাচ্ছে, মাথা নাচাচ্ছে, বুক কাঁপাচ্ছে। চেয়ার থেকে শরীরটা দুলছে সোনালতার মতো। নারী বলল, হয়েছে হয়েছে, আর বলতে হবে না। আমি আর হাসতে পারছি না। হি হি, হি হি…।
তৃতীয় পুরুষও হাসলেন। একটু শব্দ করেই হাসলেন। তবে নারীর মতো এত জোরে শব্দ করে নয়। বললেন, এখন বুঝেছ তো, আমি কেন আজ বিসমিল্লাহ খাঁর সানাই শুনছি? বাংলাদেশে ওসব সিনেমা করা বন্ধ হয়ে গেছে সেই বিশ-পঁচিশ বছর আগেই। এখন আমার আর ওসব সিনেমায় অভিনয় করার প্রশ্নই আসে না। আর সুযোগও নেই। এখন করি প্যাকেজ নাটক বা থ্রিলারধর্মী কী সব সামাজিক সিনেমা। আমি অভিনয় করি বাবা-চাচার চরিত্রে। আর আজকালকার নায়করা কী অভিনয় যে করে! দর্শকরা হলের দিকে যেতেই চায় না। আর অ্যাকশান দৃশ্যগুলোতে কী সব টেকনোলজি ব্যবহার করে, নায়কের একটা ঘুসিতে ভিলেনের দশজন চামচা একসঙ্গে পাঁচমিনিট আকাশে ওড়ে। কী আবোলতাবোল ব্যাপার!
– ওগুলো তো হলিউড বা বলিউড সিনেমায়ও ব্যবহার করে।
– কোনগুলো?
– ওই যে বললে, টেকনোলজি?
– হলিউড বা বলিউডের কথা আলাদা। ওদের সিনেমায় মৌলিকত্ব আছে। আর আমাদের সিনেমাগুলো ওদের নকল। অনেকটা কাকের ময়ূরপুচ্ছ পরার মতো।
– তা মানলাম। কিন্তু আজকাল বাংলাদেশে বেশ ভালো সিনেমাও হচ্ছে।
– ভালো সিনেমা? নাম বলো?
– আয়নাবাজি, ডুব, বৃহন্নলা, গাড়িওয়ালা, হালদা, জালালের গল্প বা বাপজানের বায়োস্কোপ?
– গাড়িওয়ালা সিনেমাটা দেখেছো? অতশত আন্তর্জাতিক পুরস্কার দেখে আমি একদিন আগ্রহ নিয়েই সিনেমাটা দেখতে বসেছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস কর, পুরো সিনেমাটা দেখার মতো আমার ধৈর্য হয়ে ওঠেনি। পাঁচমিনিটের কাহিনিও না। কী সব আজাইরা সিন ঢুকিয়ে সিনেমাটা দুই না আড়াইঘণ্টা বানিয়েছে। সিনেমাটা দেখতে বসে মনে হয়েছে, আমি যেন বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের ওপর কোনো একটা ডকুমেন্টারি দেখছি, সিনেমা নয়। আবার ঠিক ডকুমেন্টারিও বলা যায় না। একটা আজব বস্তু বানানো হয়েছে।
– আয়নাবাজি দেখেছ?
– হ্যাঁ, দেখেছি। ওটা সিনেমা বা সিনেমার জাতও না। ওসব কি আমাদের সমাজে বাস্তবে হয়? তবে একটা হাস্যকর কথা শুনেছি। আয়নাবাজির পরিচালককে নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বানিয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ সেই পরিচালক আইএ পাশও না।
– ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কেন?
– আয়নাবাজির মতো সিনেমা বানানোর জন্য?
– এটা আবার কেমন কথা?
– হ্যাঁ, সে এমন একটা যুগান্তরকারী সিনেমা বানিয়েছে, তাকে পুরস্কৃত করতে হবে না?
– এ জন্য সরাসরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বানিয়ে দেওয়া?
– আমাদের দেশটা হলো সব সম্ভবের দেশ, এটা তুমি ভালো করেই জানো।
নারী মাথা ঝাঁকাল। কিছু বলল না।
তৃতীয় পুরুষ নিজ থেকে বলল, আজকাল আমাদের দেশের চলচ্চিত্রে যা হচ্ছে, নাটককে সিনেমা হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছে। টেলিফিল্ম নামক বস্তুটাই এখন বাংলাদেশের ফুল-লেন্থের ফিল্ম।
– নাহ, আমি তোমার কথায় একমত নই। বাংলাদেশে ওসব সিনেমার বাইরেও শুধুমাত্র সিনেমা হলগুলোর জন্য সিনেমা বানানো হচ্ছে। ভারত-বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনার সিনেমাও কম হচ্ছে না। ওই যে, শাকিব খান, জায়েদ খান বা অনন্ত জলিল। ওরা তো আর টেলিফিল্ম করে না।
– ওদের কথা বলে ভালোই করেছ। ওগুলো কি সিনেমা? নাকি বলিউডের সিনেমার বিকৃত কপি? ওসব সিনেমার আবেদন কোথায়? তুমি যে আমার আশির দশকের রূপকথা বা রাজাবাদশাদের নিয়ে বানানো সিনেমাগুলো নিয়ে টিটকারি মার, ওগুলোর কিন্তু একটা আবেদন ছিল। দর্শকরা হলে যেত। আমার সিনেমা মুক্তি পেলে অনেক হলই হাউজফুল থাকত। কিন্তু আজকাল ওদের সিনেমাগুলো দর্শক টানে না কেন? বাংলাদেশে একের পর এক হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রযোজকরা তাদের মূলধনই তুলতে পারছে না। এরই মধ্যে চলচ্চিত্রে কীসব রাজনীতি ঢুকেছ। আর নায়কদের অবস্থা দেখ, আমাদের সময় নায়ক রাজ্জাক পঞ্চাশবছর বয়সেও নায়কের অভিনয় করেছেন। কিন্তু দর্শক তাঁর সিনেমা পাগলের মতো গ্রহণ করেছে। সোহেল রানা ছিলেন একেবারে টাক মাথার। সবসময় পরচুলা পরে থাকতেন। কিন্তু তাকে হিম্যান লাগত, জেনুইন মনে হতো। দর্শক তার স্টাইল ফলো করত। ফারুকের সেই হাসি! আহা, তার সারেং বৌ বা লাঠিয়াল সিনেমা…। কী আবেদন ছিল সিনেমাগুলোতে। আর নায়কদের কী অভিব্যক্তি! কিন্তু আজকাল দেখ, অনন্ত জলিল নাকি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সুপারহিরো। অথচ সে ভালোভাবে ডায়লগই ডেলিভারি দিতে পারে না। শাকিব খান কেন মেয়েদের মতো লিপস্টিক পরে নায়কের অভিনয় করে? তাকে দেখতে হিজড়া-হিজড়া মনে হয়। তুমি আবার ভেবো না, আমি হিজড়াদের ছোট করে বলছি। আমি দর্শকদের প্রতি নায়কদের আবেদনের কথা বলছি। তাদের পারসোনালিটির কথা বলছি, যা দর্শকরা অনুকরণ করবে।
নারী সায় দিয়ে বলল, ওটা অবশ্য ঠিক বলেছ। স্কুল-কলেজে পড়াকালীন ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আমাদের গঞ্জের লাকি হলে গিয়ে সিনেমা দেখতাম। তখন আসলেই সিনেমাগুলো আমাদের টানত। কিন্তু এখন আর সেভাবে টানে না। শেষ কবে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখেছি, মনে নেই। আমার না হয় খানিকটা বয়স হয়েছে। কিন্তু আজকালকার তরুণ-তরুণীদেরও তো দেখি না সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে।
তৃতীয় পুরুষ বললেন, হ্যাঁ। ঠিক বলেছ। বিনোদনই যদি না পায় তাহলে টাকা খরচ করে ওরা সিনেমা হলে যাবে কেন? ওরা অন্যকিছু করবে।
নারী বলল, অবশ্য ইন্টারনেটের যুগ তো, স্যাটালাইট টেলিভিশনে ওরা ঘরে বসেই সবকিছু পায়। ওটাও একটা কারণ।
– আমি তা মানলাম। কিন্তু ভারতে কি ইন্টারনেট বা স্যাটেলাইট টেলিভিশন নেই? ওখানকার চলচ্চিত্র হলিউডের চলচ্চিত্রকে হার মানিয়ে দেশের বাজার যেমন-তেমন, বিশ্ববাজারটাও দখল করছে। দিনদিন ওখানকার চলচ্চিত্র ব্যবসা বেড়েই যাচ্ছে। আর আমাদের চলচ্চিত্র ধ্বংস হচ্ছে। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্রে এখনো যে মৌলিকত্ব আছে, আমাদের চলচ্চিত্রে তা নেই। অথচ পশ্চিমবঙ্গ ভারতের একটা প্রদেশ। হিন্দি দ্বারা আগ্রাসিত। আর আমাদের দেশটা একটা স্বাধীন দেশ। বাংলা আমাদের একমাত্র ভাষা।
– তোমার দেখি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ওপর প্রচণ্ড ক্ষোভ।
– ক্ষোভ নয়, আক্ষেপ। বলতে পার ভেতরের কষ্ট। একটা কথা মনে রেখ, পৃথিবীর কোনো জিনিসই টিকে থাকে না যদি এর মৌলিকত্ব না থাকে। এমনকি ব্যক্তিগত সম্পর্কও।
– ব্যক্তিগত সম্পর্কও?
– জি ম্যাডাম। ব্যক্তিগত সম্পর্কও।- বলেই তৃতীয় পুরুষ একটু থামলেন। বললেন, দেখ দেখি, কোন প্রসঙ্গ থেকে কোন প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছি। কথা শুরু হয়েছিল আমার বিবাহবার্ষিকী দিয়ে। এখন কোথায় এসে ঠেকল?
নারী মৃদু হেসে বলল, এখন ঠিক জায়গায় এসেই থেমেছে। এই যে, তুমি ব্যক্তিগত সম্পর্কেও মৌলিকত্ব থাকার কথা বলছ?
তৃতীয় পুরুষ একটা দিঘল হাসি দিয়ে বললেন, তুমি সত্যি জিনিয়াস। দ্যাট’স হুয়াই আই লাভ ইউ সো মাচ।
– হয়েছে, এত বেশি করে বলতে হবে না। আজ তোমার কততম বিবাহবার্ষিকী?
– কততম বিবাহবার্ষিকী? ভালো প্রশ্ন করেছ। একটু ভাবতে হবে তো। হা হা হা হা।
– আচ্ছা, ভাব। আমি একটু ভেতরে যাই। বাথরুম থেকে আসি। এতক্ষণ আমাকে এভাবে বসিয়ে রেখেছ।
তৃতীয় পুরুষ বলল, সরি সরি। আচ্ছা, তুমি বাথরুম থেকে আস। তুমি আসার পরই আমরা উঠব।
নারী জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবে?
– যাত্রাবাড়ি যাব। আজ ভালো একটা রেস্টুরেন্টে খাব। এখন তুমিই তো আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। আর বাকি কাছের মানুষগুলো তো অনেক দূরে দূরে। মেয়ে আমেরিকার জর্জিয়ায়। আর…!
– আর কি?
– আর আমার প্রাক্তন স্ত্রী আমেরিকার নিউজার্সিতে।
– তোমার প্রাক্তন স্ত্রীকে কি এখনো আপন ভাব?
তৃতীয় পুরুষ বলল, হ্যাঁ, সে ছিল আমার প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসা!
নারী জিজ্ঞেস করল, আর দ্বিতীয় প্রেম ও ভালোবাসা?
তৃতীয় পুরুষ বলল, হয়েছে, এত বেশি বেশি প্রশ্ন করতে হবে না। বাথরুমে গেলে তাড়াতাড়ি যাও। আমাদের আবার রেডি হয়ে বাইরে যেতে হবে।