ত্রিদিবেশ বর্মন
করোনার প্রকোপে কমবেশি সব শিল্পই ব্যাপকভাবে মার খেয়েছে। মিডিয়াও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক্স বা ডিজিট্যাল সব মিডিয়াই বিপুল আর্থিক ক্ষতির সন্মুখীন হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এর কোপ এসে পড়েছে গণমাধ্যম কর্মীদের উপর। লকডাউনের মাঝেও প্রচুর মিডিয়া কর্মী কাজ হারিয়েছেন আচমকাই। অনেককে আবার “নো ওয়ার্ক নো পে” ভিত্তিতে “ছুটি” দেওয়া হয়েছে। এই মুহুর্তে তাঁদের পক্ষে অন্য কোথাও কাজ জোটানো সম্ভব নয়। ফলে ঘোর সংকটে পড়েছেন প্রচুর মানুষ। ভারতে বর্তমানে প্রায় হাজার খানেক টিভি চ্যানেল রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই নিউজ চ্যানেল। এছাড়া দৈনিক সংবাদপত্র রয়েছে কয়েক হাজার।
সংবাদপত্র জগত
গোটা বিশ্বেই সংবাদপত্রের স্বাস্থ্য এমনিতে ভালো নয়। দ্রুত খবর পৌঁছে দেওয়ার ইঁদুর দৌড়ে তারা বেশ কয়েক কদম পিছিয়ে পড়েছে। বড়ো, মেজো, ছোটো সব সংবাদপত্রের মালিকের কপালে এখন চিন্তার ভাঁজ। গোঁদের উপর বিষফোঁড়ার মতো হাজির হয়েছে লকডাউন। মাত্র কয়েকদিন আগে গুজবের বশবর্তী হয়ে কিছু মানুষ তো সংবাদপত্র পড়া বন্ধ করে দিলেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে শুরু করে চিকিৎসা বিজ্ঞানী সবাই জানালেন সংবাদপত্র পড়লে করোনা হয় না। মায় দেশের প্রধানমন্ত্রীকে পর্যন্ত এ ব্যাপারে মুখ খুলতে হল! কিন্তু ততদিনে অনেক ক্ষতি হয়েছে। প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্রের প্রচারসংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে গিয়েছে। অনেক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার ব্যায় সংকোচনের জন্য পেপার কিনছেন না। বিজ্ঞাপনদাতারা নতুন করে বিজ্ঞাপন দিতে অনীহা প্রকাশ করছেন।
একটা সংবাদপত্রের জন্য পাঠক বড়োজোর চার থেকে পাঁচ টাকা খরচ করেন। সেই টাকার মাত্র ৬০ শতাংশ মালিকের ঘরে যায়। হকার, ডিস্ট্রিবিউটার, পরিবহণ বাবদ বাকি টাকা বরাদ্দ। অথচ একটা পেপার ছাপতে কমপক্ষে ১২ টাকা খরচ হয়। বিজ্ঞাপনদাতারা প্রডাকশন কস্টের বাকি টাকা ভর্তুকি দেন। অর্থাৎশুধুমাত্র বিজ্ঞাপন থেকে সংবাদপত্রের রেভেনিউ আসে। এখন বিজ্ঞাপন প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সংবাদপত্রগুলি এডিশন পাতার সংখ্যা কমিয়েছে। তারা এক প্রকার বাধ্য হয়েই কম সংখ্যক কাগজ ছাপছে। আর চলছে যথেচ্ছহারে কর্মী ছাঁটাই। আউটলুকের মতো সম্ভ্রান্ত ম্যাগাজিন তাদের প্রিন্ট এডিশন বন্ধ করে দিয়েছে। এখন শুধুমাত্র অনলাইনে চলছে তাদের বিচরণ। হিন্দুস্থান টাইমস, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, টাইমস অব ইন্ডিয়া, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, দ্য হিন্দুর মতো মিডিয়া জায়ান্টরা ব্যায়ভার কমানোর জন্য তাদের কর্মীদের বেতন কেটে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দ্য হিন্দু পত্রিকার যে কর্মীরা বার্ষিক ছয় লাখ টাকার উপর বেতন পান, তাঁদের বেতনে ভালোরকম কোপ পড়বে। মিডিয়ার ব্যবসায় টাইমস অব ইন্ডিয়া সারা বিশ্বেই রাঘব বোয়াল হিসাবে পরিচিত। কিন্তু ঘাটতি কমাতে তাদের রবিবারের ক্রোড়পত্র “টাইমস লাইফ” আট পাতা থেকে কমে এক পাতায় এসে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি, দুজন বিভাগীয় এডিটর সহ মোট তিনজনকে ছাঁটাই করা হয়েছে। তাঁদের একজন নিউজলন্ড্রিকে জানিয়েছেন, বেশ কিছুদিন ধরেই রেভেনিউ কম আসছিল। কিন্তু কোভিড-১৯ কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দিল। বৃহত্তর মিডিয়া হাউসের যদি এই অবস্থা হয়, তবে ছোটো কাগজের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। বাংলা সংবাদপত্রগুলিও একই পথের পঠিক। আনন্দবাজার ছাড়া অন্যান্য প্রায় সব কাগজই তাদের রবিবাসরীয় ক্রোড়পত্র বন্ধ করে দিয়েছে। এই সংকট থেকে বাঁচতে সংবাদপত্র মালিকদের একাধিক সংগঠন কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রকের দারস্থ হয়েছে।
টেলিভিশন জগত
ভারতে সংবাদপত্রের চেয়েও অনেক কম পরিমান অর্থ একজন দর্শক খবরের চ্যানেল দেখতে খরচ করেন। এখন বেশিরভাগ নিউজ চ্যানেলই ফ্রি টু এয়ার। মাত্র কয়েক পয়সায় অন্য নিউজ চ্যানেলগুলি পাওয়া যায়। ফলে আর্থিক লাভের জন্য টিভি মিডিয়া পুরোপুরিভাবে বিজ্ঞাপনের উপর নির্ভর করে। কিন্তু লকডাউনের এই বাজারে বিজ্ঞাপনদাতারা পিছিয়ে আসছেন। পাশাপাশি বিনোদন চ্যানেলগুলির টিআরপি অনেক বেশি হওয়ায় বিজ্ঞাপনদাতারা ওই চ্যানেলগুলিকে বেছে নিচ্ছেন। ফলে টিকে থাকার লড়াইয়ে নিউজ চ্যানেলগুলিকে বিজ্ঞাপন রেট কমাতে হচ্ছে। বর্তমানে একটি বা দুটি হিন্দি নিউজ চ্যানেল ও কয়েকটি জনপ্রিয় রিজিওনাল নিউজ চ্যানেল ছাড়া বাকি সব ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া আর্থিক ক্ষতির সন্মুখীন হয়ছে। এ দেশের সব ইংলিশ নিউজ চ্যানেলের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছে। এনডিটিভি কর্তৃপক্ষ তাদের কর্মীদের বেতন কেটে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যে কর্মীদের মাসিক বেতন ৫০ হাজারের বেশি, তাঁদের ১০ থেকে ৪০ শতাংশ বেতন কেটে নেওয়া হবে। ওংকার অনলি ট্রুথ নামে এক বাংলা টিভি চ্যানেল তাদের টেলিকাস্ট বন্ধ রেখেছে। তাদের কর্মীদের বেতন ছাড়াই “ছুটি’’ দেওয়া হয়েছে।
ডিজিট্যাল মিডিয়া
ভারতে ডিজিট্যাল মিডিয়াকে এখনও এলিট শ্রেণি হিসাবে ধরা হয় না। অথচ বর্তমান সময়ের নিরিখে এর গুরুত্ব অপরিসীম। ডিজিট্যাল মিডিয়াকেই খবরের ভবিষ্যৎ হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু ডিজিট্যাল মিডিয়ার খবরের জন্য গ্রাহকদের কোনো টাকাই খরচ করতে হয় না। গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব, ডেইলি হান্ট ইত্যাদি অ্যাপের মাধ্যমে ডিজিট্যাল মিডিয়া সামান্য অর্থ আয় করে। বিজ্ঞাপন থেকে সরাসরি টাকা তাদের ভাঁড়ারে যায় না। এই কারণে প্রচুর ডিজিট্যাল মিডিয়া ঝাপ গোটাতে বাধ্য হয়েছে। ডিজিট্যাল বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে এ দেশে উল্লেখযোগ্য কোনো আইন নেই। সংবাদপত্রগুলির ডিজিট্যাল সংস্করণের তরফে গুগল, ফেসবুকের কাছে বিজ্ঞাপনী আয়ের আরও অর্থ দাবি করা হয়েছে।
কয়েকদিন আগে নিউজ নেশন নামে একটি চ্যানেল তাদের ইংলিশ ওয়েব ডেস্ক বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে বেশ কয়েকজন সাব এডিটরকে চাকরি খোয়াতে হয়েছে। টিভি-১৮ নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা রাঘব বহাল ২০১৫ সালে The Quint নামে ডিজিট্যাল মিডিয়া চালু করেন। এটি দেশের অন্যতম বড়ো ডিজিট্যাল মিডিয়া হাউস। লকডাউনের মাঝে দ্য কুইন্ট একযোগে ৪৫ জন কর্মীকে ছাঁটাই করেছে। তাঁদের মধ্যে একজন সাংবাদিক সম্প্রতি একটি বিখ্যাত পুরস্কার জিতেছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন নিউজ এজেন্সি থেকে সাবক্রিপশন বন্ধ রেখেছে দ্য কুইন্ট।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে মিডিয়া সরকারি অনুগ্রহ লাভের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়বে। ফলস্বরূপ খবরে ফ্যাক্টের চেয়ে সরকারি ন্যারেটিভ বেশি প্রাধান্য পাবে। এমনিতেই জরুরি অবস্থার পর গত দশক মিডিয়ার জন্য ভয়াবহ কালো অধ্যায় ছিল। এই পরিস্থিতি বেশিদিন চলতে থাকলে মিডিয়ার জন্য আরও কালো দিন অপেক্ষা করবে।
খুব তথ্য সম্মৃদ্ধ লেখা। এবং বিপদ যেটুকু আমরা জানতাম, আরো বেশী তা, বুঝলাম। খুব ভাল লিখেছিস, ত্রিদিবেশ।