নিউজপিডিয়া ডেস্ক, ২৮ জুনঃ তামিলনাড়ুর তুতিকোরিনে পুলিশি হেফাজতে পি জয়রাজ(৫৮) এবং তাঁর ছেলে জে বেনিকসের(৩১) মৃত্যুতে তোলপাড় গোটা দেশ। এই ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। টুইটারে #justiceforjayrajandfenix ট্রেন্ড চলছে। এমনকি এই মৃত্যুর ঘটনাকে আমেরিকার জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার সঙ্গেও তুলনা করছেন অনেকে। সরব হয়েছেন সমাজের সকল স্তরের মানুষ। রাজনীতিবিদ, অভিনেতা থেকে ক্রিকেটার সবাই এই বর্বরোচিত ঘটনার নিন্দায় মুখর। তামিলনাড়ুর সাধারণ মানুষ ও বিরোধী দল ঘটনার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে। এবার চেন্নাই হাইকোর্টও আসরে নামলো। ২৬ জুলাইয়ের মধ্যে এই ঘটনার বিস্তারিত রিপোর্ট চেন্নাই পুলিশের কাছে তলব করেছে কোর্ট।
কোভিড কারফিউ ভঙ্গ করার ‘অপরাধে’ পুলিশি অত্যাচারে পি জয়রাজ এবং জে বেনিকস-এর মৃত্যু হয় বলে অভিযোগ। এই ঘটনায় এখনও পর্যন্ত কারোর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয়নি। তুতিকোরিনের সাথানকুলাম শহরে বাবা-ছেলের মত্যুর ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশ কর্মী, এদের পুলিশি হেফাজতে দেওয়ার জন্য ফিট সার্টিফিকেট দেওয়া সরকারি ডাক্তার, এদের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দেওয়া ম্যাজিস্ট্রেট বা জেলকর্মী কারোর বিরুদ্ধেই এখনও কোনও আইনি ব্যবস্থা নেয়নি তামিলনাড়ু সরকার।
সাথানকুলাম শহরে রাত আটটার মধ্যে দোকানপাট বন্ধ করার নির্দেশ জারি রয়েছে। নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও দোকান খুলে রাখার ‘অপরাধ’-এ বাবা ও ছেলেকে পিটিয়ে হত্যা করার অভিযোগ উঠল তামিলনাড়ু পুলিশের বিরুদ্ধে। নৃশংস শারীরিক অত্যাচার চালানোর পাশাপাশি তাঁদের উপর যৌন নির্যাতন চালানো হয় বলেও অভিযোগ উঠছে। পুলিশের বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়ের করতে হবে বলে দাবি জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, পি জয়রাজ পেশায় কাঠের ব্যবসায়ী। ইম্যানুয়েল একটি মোবাইলের দোকান চালাতেন। ঘটনার সূত্রপাত গত ১৯ জুন। সেদিন রাত সওয়া ৮টা নাগাদ দোকানের শাটার নামাতে যান জয়রাজ। নির্ধারিত সময়ের ১৫ মিনিট পর কেন দোকান বন্ধ করা হচ্ছে, তা নিয়ে এলাকায় টহল দেওয়া পুলিশকর্মীদের সঙ্গে তাঁর বচসা বাধে। ইম্যানুয়েলও বচসায় জড়িয়ে যান। কিছুক্ষণ পর বিষয়টি মিটে গেলে দু’জনে বাড়ি ফিরে যান।
স্থানীয়দের অভিযোগ, তার পরেরদিন রাত ৭টা ৪৫ মিনিট নাগাদ একদল পুলিশকর্মীকে নিয়ে দোকানে হাজির হন সাথানকুলাম থানার সাব ইনস্পেকটর বালকৃষ্ণণ। সেই সময় দোকানে জয়রাজও উপস্থিত ছিলেন। আগের দিনের ঘটনা নিয়ে নতুন করে তর্ক শুরু হয়। এর পরেই জয়রাজকে জোর করে গাড়িতে তুলে নেয় পুলিশ। এক বন্ধুর সঙ্গে দোকানের ভিতর দিকে ছিলেন ইম্যানুয়েল। বাবাকে পুলিশ তুলে নিয়ে যাচ্ছে দেখে তিনি আটকাতে যান। কিন্তু তাঁকে থানায় আসতে বলে জয়রাজকে নিয়ে চলে যায় পুলিশের গাড়ি।
এর পর কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে আইনজীবী নিয়ে থানায় যান ইম্যানুয়েল। তাঁকেও হাজতে পোরার নির্দেশ দেয় পুলিশ। ইম্যানুয়েলের এক বন্ধু রাজেশ জানান, তাঁদের বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে কয়েকজন পুলিশ মিলে হাজতের মধ্যে ইম্যানুয়েল ও তাঁর বাবাকে বেধড়ক মারধর করে। মাঝ রাত পর্যন্ত লাঠি দিয়ে তাঁদের পেটাতে থাকে পুলিশ।
ইম্যানুয়েলের বন্ধুদের দাবি, ২১ জুন সকাল ৭টা নাগাদ ফের আইনজীবী নিয়ে থানায় হাজির হন তাঁরা। তাঁদের জানানো হয়, জয়রাজ এবং ইম্যানুয়েলের বিরুদ্ধে ১৮৮ (সরকারি নির্দেশ অমান্য), ৩৫৩ (সরকারি কর্মীকে কাজে বাধা দেওয়া), ২৬৯ (দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবে জীবননাশক সংক্রমণ ছড়ানো) এবং ৫০৬ (২) (অপরাধমূলক হুমকি) ধারায় মামলা দায়ের হয়েছে। ইম্যানুয়েলের আইনজীবী এস মণিমারন জানিয়েছেন, হাজতের যেখানে জয়রাজ এবং ইম্যানুয়েলকে বসিয়ে রাখা হয়েছিল, সেই জায়গাটা রক্তে ভেজা ছিল।
মণিমারনের দাবি, জয়রাজ এবং ইম্যানুয়েলের জন্য তাঁরা পরিষ্কার জামাকাপড় নিয়ে গিয়েছিলেন। সেটা পরিয়ে তাঁদের হাসপাতালে নিয়ে যায় পুলিশ। হাসপাতালে যাওয়ার পথে গাড়িতে তাঁদের বসার আসনের উপর কম্বল পাতা হয়েছিল। কিন্তু বাবা-ছেলের শরীর থেকে এত রক্ত বেরোচ্ছিল যে, সেই কম্বলটাও ভিজে যায়। তিনি জানান, তাঁর মক্কেলরা জানিয়েছেন, হাজতের ভেতর মারধরের পাশাপাশি তাঁদের মলদ্বারে লাঠি ঢুকিয়ে অত্যাচার চালায় পুলিশ। দু’জনের বুকে রোম ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল।
জয়রাজ ও তাঁর ছেলেকে ওই অবস্থায় দেখেও হাসপাতালের চিকিৎসকেরা তাঁদের দু’জনকেই ‘ফিট সার্টিফিকেট’ লিখে দেন। শুধু তাই নয়, হাসপাতালে থাকাকালীন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বাবা-ছেলেকে পুলিশি হেফাজতে নেওয়ার আর্জি জানায় পুলিশ। দু’জনকে না দেখেই তাতে অনুমতি দেন ম্যাজিস্ট্রেট। এমনটাই অভিযোগ মণিনারনের।
ওই আইনজীবীর দাবি, হাসপাতাল থেকে কোভিলপট্টি উপ সংশোধনাগারে নিয়ে যাওয়া হয় বাবা ও ছেলেকে। সেখানে তাঁদের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে দুজনকেই সন্ধ্যায় কোভিলপট্টি হাসপাতালে পাঠানো হয়। সোমবার রাতে হাসপাতালেই ইম্যানুয়েলের মৃত্যু হয়। মঙ্গলবার সকালে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় জয়রাজও মারা যান।
জয়রাজের মেয়ে পার্সিস বলেন, ‘‘জামিন হয়ে যেত বাবা-দাদার। সব বন্দোবস্ত হয়ে গিয়েছিল। বুধবারই দু’জনের বাড়ি ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু আমাদের কাছ থেকে ওদের চিরতরে ছিনিয়ে নেওয়া হল। নৃশংস অত্যাচার চালানো হয় ওদের উপর।’’
এদিকে এই ঘটনার ন্যায়বিচারের দাবি তুলেছেন অনেকেই। রাহুল গান্ধী টুইট করে লিখেন, “পুলিশি বর্বরতা একটা ভয়ঙ্কর অপরাধ। আমাদের রক্ষকরা যখন অত্যাচারী হয়ে যায় সেটা দুর্ভাগ্যজনক। ওই পরিবারের প্রতি আমার সান্ত্বনা রইলো। সরকারকে অনুরোধ করবো ন্যায় বিচার সুনিশ্চিত করার ব্যাপারে।’’
সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরি এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, “আমি এই জঘন্য এবং ভয়ংকর ঘটনার তীব্র নিন্দা করছি। অপরাধী পুলিশ কর্মীদের বিরুদ্ধে আইপিসি ৩০২ ধারায় মামলা করা হোক। ওই পরিবারকে কমপক্ষে ১ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক। এছাড়া চাকরির ব্যবস্থা করা হোক।”
অভিনেত্রী প্রিয়াঙ্কা চোপড়া লিখেছেন, “এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না যা শুনছি। এই ঘটনায় আমি মর্মাহত, দুঃখিত ও ক্রুদ্ধ। কেউ দোষী হলেও তাকে এরকম পাশবিক নির্যাতন করা উচিত নয়।’’ বেশিরভাগ বলিউডি তারকার চুপ থাকা নিয়ে মুখ খুলেছেন সমাজকর্মী জিগ্নেশ মেবানি। তিনি জানান, অন্য দেশে কোনো কিছু হলে সেলিব্রিটিরা মুখ খোলে। কিন্তু তামিলনাড়ুর ব্যাপারে তারা চুপ। ক্রিকেটার শিখর ধাওয়ান, মনোজ তিওয়ারি, ইরফান পাঠানরাও দোষীদের শাস্তির দাবি তুলেছেন। টুইটারে ইরফান বলেন, “তুতিকোরিনে ভয়ানক ঘটনা ঘটেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেক কেসই সামনে আসে না। ওই পরিবার ন্যায়বিচার পাক।’’ সাংবাদিক বরখা দত্তের সঙ্গে আলাপচারিতায় গায়িকা তথা আরজে সুচিত্রা এই ঘটনাকে জর্জ ফ্লয়েডের ঘটনার সঙ্গে তুলনা করেছেন।