হিল্লোলবাসিনী বাগলী ছিলেন যথার্থই বীরাঙ্গনা
মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি
ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে পুরুষদের পাশাপাশি বহু নারীও তাঁদের সর্বস্ব ত্যাগ করে, জীবনকে তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, বীরাঙ্গনা মাতঙ্গিনী হাজরা, সশস্ত্র বিপ্লবী শান্তি, সুনীতি, বীণা প্রমুখ স্বাধীনতাকামী নারীরা স্বাধীনতা আনয়নে অংশগ্রহণ করে আজও অমর হয়ে রয়েছেন। ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আছে তাঁদের মহান আত্মবলিদানের কথা। কিন্তু এমন বহু নারী স্বাধীনতা সংগ্রামী আছেন যাঁদের কথা আমরা বিশেষ জানি না। অথচ তাঁদের অবদানও কম ছিল না। কখনো বিপ্লবীদের গোপনে আশ্রয় দিয়ে, তাঁদের সেবা-শুশ্রুষা করে, তাঁদের মুখে খাবার অন্ন-জল তুলে দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের কাজকে জোরদার করে তুলেছিলেন। আবার অনেক নারী ছিলেন যাঁরা সরাসরি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। এরকমই একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী হলেন হিল্লোলবাসিনী বাগলী। যিনি ছিলেন যথার্থই একজন বীরাঙ্গনা। স্বাধীনতাকামী স্বাধীনচেতা। এই নারী ছিলেন ময়নাপুরের প্রখ্যাত স্বাধীনতাযোদ্ধা ভীমাচরণ বাগলীর সহধর্মিনী। যোগ্য স্বামীর যোগ্য স্ত্রী। ভীমাচরণ বাগলী ছিলেন গান্ধীবাদী স্বাধীনতা সংগ্রামী। হিল্লোলবাসিনীও স্বামীর পথ অনুসরণ করেন।
একদিকে ভীমাচরণ বাগলী যখন দেশের যুবকদের নিয়ে আইন অমান্য ও সত্যাগ্রহ আন্দোলনকে জোরদার করার কাজে লিপ্ত আছেন তখন অন্যদিকে হিল্লোলবাসিনী নারীদের নিয়ে আন্দোলন সংগঠিত করেছেন। স্বামীর মতো থানা দখল, পিকেটিং, সদস্যা সংগ্রহ ইত্যাদির কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। নারীদের সংগঠিত করে তাঁদের তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন।
হিল্লোলবাসিনীর জন্ম বাংলা ১৪ চৈত্র, ১৩২০ ইংরেজি ১৯১৩ সালে কোতুলপুর থানার অধীন ট্যাংরাখালি গ্রামে। হিল্লোলবাসিনীর বাবা ছিলেন একজন স্বাধীনতা পিয়াসী মানুষ। যাঁরা দেশের মুক্তির জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেছেন তাঁদের মনে-প্রাণে ভালোবাসতেন তিনি। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি বাবার এই ভালোবাসা, অকুণ্ঠ সমর্থন অল্প বয়সেই হিল্লোলবাসিনীর জীবনে প্রভাব ফেলেছিল।
মাত্র ন’বছর বয়সে ময়নাপুরের ভীমাচরণ বাগলীর সাথে হিল্লোলবাসিনীর বিয়ে হয়ে যায়। শ্বশুরবাড়িতে এসে দেখেন তাঁর শ্বশুরবাড়ির অর্থাত্ বাগলী পরিবারের প্রায় প্রত্যেককেই স্বাধীনতা সগ্রামের মন্ত্রে দীক্ষিত। স্বামী ভীমাচরণ বাগলি স্বাধীনতা সংগ্রামী, ভাশুর ধর্মদাস বাগলী বিপ্লবী, জা সরোজিনী বাগলী দেশের জন্য উৎসপর্গীকৃত প্রাণ। স্বাভাবিকভাবেই এমন একটা আবহাওয়া ও পরিবেশের মধ্যে থেকে হিল্লোনবাসিনী আর নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারেননি। স্বামীর পথ অনুসরণ করে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেন। বড়ো জা সরোজিনী বাগলী, মা ননীবালা ঘোষ, কিরণবালা ঘোষ প্রমুখ নারীদের সংঘবদ্ধ করে জয়পুর থানা দখল করে সেখানে পতাকা উত্তোলন করেন।
জয়পুর থানা দখল ও পতাকা উত্তোলনের অপরাধে ইংরেজ সরকার হিল্লোলবাসিনী বাগলী ও সরোজিনী বাগলীকে গ্রেপ্তার করে। বিচারে তাঁদের ছ’মাস জেল হয়। মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে তাঁদের রাখা হয়।
এদিকে পুলিশ যাতে ধরতে না পারে তাই ভীমাচরণ বাগলীও সে সময় আত্মগোপন করে আছেন। সেই সুযোগে তাঁদের সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেয় ইংরেজ সরকার। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ফিরে আসার পর হিল্লোলবাসিনীদের আর থাকার জায়গা ছিল না। এসময় হিল্লোলবাসিনীকে নিদারুণ কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। বাড়ির নিকটে একটি বকুল গাছ ছিল(যা এখনও বর্তমান), ঝোপ-জঙ্গলে ভর্তি সেখানে সেই গাছের তলায় কোন রকমে দিন কাটাতে হত রোদ-ঝড়-জলকে উপেক্ষা করেই। খাবারও এসময় জুটত না। যা জুটত মাটির হাঁড়িতে ফুটিয়ে কোনরকমে গলাধকরণ করতেন। এ সময়ে হিল্লোলবাসিনী ছিলেন সন্তানসম্ভবা। ঝোপ-জঙ্গলে ভরা সেই বকুল গাছের তলায় তিনি সন্তান প্রসব করেন। কিন্তু সে সন্তানকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
এভাবে বহু কষ্টের দিন অতিবাহিত করেছেন হিল্লোলবাসিনী যা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। কিন্তু পুলিশি নির্যাতনকে ও তাদের রক্তচক্ষুকে পাত্তাই দেননি তিনি। এরকমই কষ্টসহিষ্ণু ও দৃঢ়চেতা মনের মানুষ ছিলেন হিল্লোলবাসিনী। বারেবারে ইংরেজ পুলিশ হিল্লোলবাসিনীকে জেলে ভরেছে। ছাড়া পেয়ে আবার স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।
স্বামী ভীমাচরণ বাগলী মারা যাওয়ার পরও দীর্ঘকাল বেঁচে ছিলেন হিল্লোলবাসিনী বাগলী। ভারত সরকার তাঁকে তাম্রপত্র দিয়ে সম্মান জানায়। স্বাধীনতা সংগ্রামীর ভাতাও নিয়মিত পেয়েছেন তিনি। ১৯৯৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর তিনি লোকান্তরিত হন।
১৯৭৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর ‘বন্দেমাতরম শতবর্ষ সমিতি’র বাঁকুড়া শাখা হিল্লোলবাসিনী বাগলীকে একটি শংসাপত্র দিয়ে সংবর্ধিত করেন। মানপত্রটি তাঁর হাতে তুলে দেন কলকাতা হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি মাননীয় শ্রী শঙ্করপ্রসাদ মিত্র মহাশয়।
মানপত্রটি ছিল এইরকম:
“শ্রী হিল্লোলবাসিনী বাগলী করকমলে-
‘বন্দেমাতরম’ মহামন্ত্রের ধারক ও বাহক তথা দেশমাতৃকার মুক্তি সংগ্রামের সৈনিক। আপনাকে অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা নিবেদন করি। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আপনার অবদান কালজয়ী। দেশমাতৃকার শৃঙ্খলমোচন সংগ্রামে আপনি জীবনপণ করিয়াছিলেন। সাম্রাজ্যবাদী শাসকের অত্যাচার ও লাঞ্ছনা সেই মুক্তি আকাঙ্ক্ষাকে দমিত করিতে পারে নাই। বহু দুর্গম ও বন্ধুর পথ অতিক্রম করিয়া “অভী:’-র পথে যাত্রা করিয়াছিলেন। আজ তাই আমাদের মাতৃভূমি বিদেশীর শৃঙ্খলমুক্ত। দেশমাতৃকার মুক্তিযজ্ঞে সংগ্রামী অবদান মল্লভূমি বাঁকুড়াকে বিশিষ্ট আসনে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে। মুক্তিযজ্ঞের মহামন্ত্রে ‘বন্দেমাতরম’ শতবর্ষ পূর্তি উৎসবে আপনাকে অভিনন্দিত করিতে গিয়া আমরা ধন্যবোধ করিতেছি।”
স্বা: শ্রী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ হোড়
বাঁকুড়া জেলা জর্জ
৪ঠা পৌষ,১৩৮৩ স্বা: শ্রী রাখহরি চট্টোপাধ্যায়
১৯ ডিসেম্বর, ১৯৭৬ সমিতির সাধারণ সম্পাদক।
হিল্লোলবাসিনী বাগলীর নশ্বর দেহ আজ আর নেই। কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর আদর্শ, দেশের প্রতি অসীম মমত্ববোধ, মহান আত্মত্যাগ। স্বাধীনতাযুদ্ধের মহান ব্রতে ব্রতী এই বীরাঙ্গনা নারীকে আমরা জানাই আমাদের অন্তরের শ্রদ্ধাঞ্জলি।