ওহিদ রেহমান: এইমুহুর্তে দেশজুড়ে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১ কোটি ছাড়িয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরেই, আমরা অবস্থান করছি দ্বিতীয় স্থানে। অথচ, করোনা নিয়ে একটু একটু করে আলগা হচ্ছে ভাবনা। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে, আমজনতার চায়ের কাপে উঠে আসছে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন থেকে একুশের নির্বাচন পূর্ব, বঙ্গ রাজনীতির নয়া সমীকরণ। ক্রিকেটে বিরাটের গোলাপী ছোবল খাওয়া থেকে সানা খানের কাশ্মীরি হানিমুন। করোনা নিয়ে সরকারি বিজ্ঞাপনের ঢাক্কানিনাদ আজ সার। অথচ, আমরা এখনো রয়েছি লাল সতর্কতার বলয়ে। হ্যাঁ, করোনা এখনো আছে বহাল তবিয়তে। আলোকপাত করছেন- ওহিদ রেহমান

গতবছর ডিসেম্বর মাসে ফিসফাস শোনা যাচ্ছিল যে সংক্রমনের ইতিবৃত্ত, বছর পেরোতেই সেই সংক্রমনের গেরোয় ভারতবর্ষ বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছে। নেপথ্যে অদৃশ্য মারণ ভাইরাস করোনা। দেশে এ বছরের ৩০ জানুয়ারি প্রথম করোনা আক্রান্তের খোঁজ মেলে কেরলে। সেই থেকে আমরা নয় নয় করে পেরিয়েছি প্রায় মাস এগারো। ফলে, প্রারম্ভিক আতঙ্কের রেশ এখন অনেকটাই আলগা। অঙ্কের নিরিখে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ এই ভাইরাসে সংক্রমিত হলে, আমাদের মাঝে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ বলয় তৈরি হবে। তাই, হয়তোবা সংক্রমনের এই ধারা দীর্ঘমেয়াদি হবে। এই সংক্রমণ যদি নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে থাকে, সেক্ষেত্রে সত্যিই আলাদাভাবে বিচলিত হবার কোন কারন দেখছি না। তবে চলমান এই পরিস্থিতিতে বিচলিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে সমাজের আশ্রয়হীন, সহায়-সম্বলহীন, দিন আনা দিন খায় মানুষদের নিয়ে। ইতিমধ্যেই, সামাজিক বৈষম্যের ছবি স্পষ্টতই প্রতীয়মান। সমাজের একটি অংশের মানুষ যখন নেটফ্লিক্স, ওয়েব সিরিজ, রকমারি রেসিপির রান্না এবং খাওয়া নিয়ে মশগুল, তখন সমাজের অন্য একটি বৃহত্তর অংশের জীবন যাপন মলিন থেকে মলিনতর হচ্ছে। আগামীর পৃথিবী অবশ্যই করোনার টিকা পাবে। কিন্তু, ততদিনে হয়তোবা সভ্যতার বিপুল চালিকাশক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে। এখানেই চলে আসে রাষ্ট্রের ভুমিকা। একটি রাষ্ট্রের সদর্থক ভূমিকা এই ক্ষতির বহরকে ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ রাখতেই পারে। তাই, শাসকের আজ অগ্নিপরীক্ষা। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এই পরিস্থিতিকে যুদ্ধের সাথে তুলনা করেছেন। রাষ্ট্রের আজ যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পাশে থাকতে হবে প্রতিটি জনপদের। যাদের কাছে বেঁচে থাকার ন্যূনতম রসদ নেই, তাদের পাশে থাকাটাই আজ রাষ্ট্রের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ।

করোনা সংক্রমনের ব্যাপ্তি বৃহত্তর জনজীবনে একটি অশনি সংকেতের বার্তা দিচ্ছে নিঃসন্দেহে। করোনা আমাদের জানান দিচ্ছে, আমরা যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছি তা মোটেই টেকসই নয়। ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আজ চূড়ান্ত সারশূন্যহীন তত্ত্বে পরিণত হয়েছে। উন্নয়নের বুলি কপচানো রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য খাত কতটা ভঙ্গুর, আমরা তা অবলোকন করছি। করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি এবং তাঁর চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসক, আজ গভীর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। অথচ, করোনা মোকাবিলায় চিকিৎসা খাতের পরিকাঠামো যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়েছে। করোনা মোকাবিলায় লকডাউন আসলে ‘স্ট্রাটেজিক টাইম আউট’, মূল দাওয়াই নয়। দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, এক্ষেত্রে হাতে গোনা কিছু রাষ্ট্র ছাড়া, কেউই সদর্থক ভূমিকা গ্রহণ করেনি। ফলে, আজ আমরা সকলেই করোনা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছি। ইতিমধ্যেই বিশ্বব্যাপী শুরু হয়েছে কর্মী ছাঁটাই অভিযান। শিল্প, বাণিজ্য, পর্যটন আজ পড়েছে মুখ থুবড়ে। একাধিক দেশ ইতিমধ্যেই আর্থিকভাবে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষিত করেছে। এই মুহূর্তে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জিডিপি অবনমন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। পরিসংখ্যানের চোখ রাখলে দেখা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি -৯.৫%, বৃটেনের -২০.৪%, কানাডার -১২%, আমাদের প্রিয় দেশ ভারতের -২৩.৯%। এডিবির প্রদত্ত তথ্যমতে করোনার কারনে বৈশ্বিক আর্থিক ক্ষতির পরিমান প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন ইউএস ডলার। শুধুমাত্র উন্নয়নশীল দেশগুলোর এই ক্ষতি পুষিয়ে নেবার জন্য দরকার প্রায় ২.৫ ট্রিলিয়ন ইউএস ডলার। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কে দেবে এই অর্থের যোগান ?
আসুন নিজ মাতৃভূমির চিত্রটি একবার দেখা যাক। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে ভারতবর্ষের আর্থিক পরিস্থিতি অত্যন্ত নিম্নমুখী। স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষ এমন চিত্র কখনোই দেখেনি। কিছুদিন পূর্বে ভারতের জাতীয় পরিসংখ্যান কার্যালয় (এনওএস) থেকে প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, করোনার ধাক্কায় প্রথম পর্বে ভোক্তা ব্যয় গত বছরের এপ্রিল-জুন সময়ের চেয়ে ৩১ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে। এ ছাড়াও এই সময়ে ম্যানুফ্যাকচারিং খাত ৩৯ দশমিক ৩ শতাংশ, নির্মাণ খাত ৫০ দশমিক ৩ শতাংশ, বাণিজ্য খাত ৪৭ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে।অর্থনীতির মূল খাতগুলো গুলো যখন মুখ থুবড়ে পড়েছে, তখন বেড়েছে ১৬ শতাংশ সরকারি ব্যয়।
করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য, গত ২৫ মার্চ থেকে টানা ৬৮ দিন লকডাউনে পরিত্রাণের উপায় খুঁজে দেশ। এই সময়ে ঝাঁপ পড়ে যায় দেশের চালিকাশক্তির সমস্ত খাতে। যার প্রভাব পড়েছে সাম্প্রতিক প্রকাশিত অর্থনীতির হাল-হকিকতে। ভঙ্গুর এই অর্থনীতিকে টেনে তুলতে ইতোমধ্যেই সরকার ২০ লাখ কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। যা দেশের জিডিপির ১০ শতাংশ। কিন্তু লকডাউন হোক কিংবা আর্থিক প্রণোদনা, আমজনতার জীবনযাত্রায় সুরাহা এখনো ফেরেনি। একদিকে করোনা, অন্যদিকে সুবিধা বঞ্চিত লাখো মানুষ। কেবলমাত্র সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন, মুঠোফোন জুড়ে বিজ্ঞাপন, এই মহামারী মোকাবিলায় যথেষ্ট নয়, এই ঘাতকের মোকাবিলায় চাই সুসংগঠিত রোডম্যাপ। সত্যি কথা বলতে, করোনা মোকাবিলায় তেমন সুসংহত আয়োজন, আজও অধরা। অন্যদিকে আমরা দেখছি, জনসাধারণের অজ্ঞতাকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে কিছু রাজনৈতিক চরিত্র। কখনো শুনছি করোনা নিধনে গোমূত্র নিদান, আবার কেউ বলছে ‘ভাবীজী পাঁপড় খান’। দেশজুড়ে এমন অদ্ভুত অদ্ভুত নিদান আকছার শোনা যাচ্ছে। অথচ, করোনা সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপনে সরকার কাড়ি কাড়ি অর্থ খরচ করছে নিত্যদিন। তবে সুখের কথা এই যে, বর্তমানে দেশে করোনার গ্রাফ কিছুটা নিম্নমুখী। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের ১৯ ডিসেম্বর ‘২০ বুলেটিন অনুযায়ী, দেশে ইতিমধ্যেই করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১,০০,০৪,৫৯৯ জন। মারা গেছেন ১,৪৫,১৩৬ জন মানুষ। ইতিমধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠেছেন ৯৫,৫০,৭১২ জন। এই মুহূর্তে দেশে অ্যাক্টিভ রোগীর সংখ্যা ৩,০৮,৭৫১ জন।
এ এক বদলে যাওয়া পৃথিবী। সভ্যতার বুনিয়াদ ‘সহযোগিতায়’ আজ ঘূন ধরেছে ‘সামাজিক দূরত্ব'(social distancing) শব্দবন্ধের অনুপ্রবেশে। অথচ, বন্যা, ভূমিকম্প, খরা, দাবানলের প্রবল পরাক্রমশালী তাণ্ডবে পৃথিবী কখনো এইভাবে মাথা নত করেনি। এই সভ্যতা কখনোই স্থবির হয়নি। এই পৃথিবী দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত নিয়ে ও গেয়েছে জীবনের জয়গান। হাজারো দুর্যোগে বুক চিতিয়ে লড়াইয়ের সাক্ষ্যবাহী এই সভ্যতা, আজ সত্যি সত্যি ধরাশায়ী। করোনা আসলে একটি চূড়ান্ত প্রণিধানময় বার্তা এই পৃথিবীর জন্য। হয়তো আগামীর পৃথিবী দেখবে আরও ভয়াবহ ঘাতকের আস্ফালন। এখন, আমরা বুঝতে পারছি, মানবজাতি আসলে কতটা অসহায় এবং একই সাথে ব্যক্তিস্বার্থের শেকলে শৃঙ্খলিত। নিজেদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য আমরা যুগ-যুগ ধরে প্রকৃতির উপর অত্যাচার করেছি। আমাদের কারণেই পরিবেশ থেকে হারিয়ে গিয়েছে হাজার হাজার প্রাণী ও উদ্ভিদের হরেক প্রজাতি। আমরা শুধু পরিবেশের উপর অত্যাচার করেই ক্ষান্ত হইনি, আমাদের লালসার শিকার আর্থিকভাবে দুর্বল জনজাতি।আমরা ক্ষমতার মোহে বুঁদ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছি তাদের উপর। মনে মননে সাম্রাজ্যবাদের সুপ্ত চারাগাছ লালন করে, আমরা আয়োজন করেছি শান্তি সম্মেলনের। তাই ২০২০ সালে এসেও আফ্রিকা, সিরিয়া, প্যালেস্টাইন, মিয়ানমার সহ বহু দেশের মানবেতর জীবনের আখ্যান ফেরি করে গনমাধ্যম। কখনো কখনো মধ্যযুগ হয়তোবা মুখ লুকাতে চায়, আমাদের অজ্ঞতায়। প্রতিদিন হাজার হাজার হৃদয় বিদারক দৃশ্যের চিত্রায়ন হচ্ছে এই পৃথিবীর বুকে। তাই, এই করোনাকালে পৃথিবী আজ আগ্রহভরে অপেক্ষা করছে মানবজাতির সদর্থক ভূমিকা গ্রহণের। আসুন, এই দুর্দিনে আমরা রচনা করি পৃথিবী রক্ষার নব্য সনদ।