ঈশ্বর
মহিবুল আলম
।। ষোল ।।
নারী বাসা থেকে বের হয়ে মুদি দোকানের কাজটা আগে সারল। মুদি দোকানটার পাশেই এই মাছওয়ালা ডালায় কইমাছ নিয়ে বসেছে। ডালাটা বেশ বড়সড়ই। কিন্তু জেতা কইমাছগুলো কাখনা চেপে এদিকওদিক চলে যাচ্ছে। মাছওয়ালা ডানহাতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কইমাছগুলো সামলাচ্ছে আর জোরে জোরে হাঁক দিচ্ছে- এই কইমাছ-কইমাছ। বিলের কইমাছ। জেতা কইমাছ। চারশো ট্যাকা কেজি। এই বিলের কইমাছ…।
নারী মুদি দোকানের বাজারসদাইগুলো হাতে নিয়েই মাছওয়ালার পাশে দাঁড়াল। কইমাছগুলো সত্যি বেশ বড়সড়। মাছগুলো কিনতে ইচ্ছে হলো তার। অন্তত এক কেজি। মেঘনার ভাঙনে তাদের নিজেদের বাড়ি ও জায়গাজমি সব বহু আগেই গেছে। কিন্তু তার নানার বাড়িতে এখনো বেশ কয়েকটা বড়সড় পুকুর আছে। এগুলো বিলের সঙ্গে সংযুক্ত। বর্ষাকালে বাঁধ কেটে দেয় বলে বিলের কইমাছ পুকুরে এসে পড়ে। নারী দেখেছে, তার নানা জেলে ডেকে এনে জাল ফেলে বেশ বড় বড় কইমাছ ধরতেন। অনেক সময় পুকুরের পানি সেচে অনেক কইমাছ মটকায় জিউল করে রাখতেন। কিন্তু মামা-মামির চাপে ও মামাতো ভাইবোনদের অহংকারে সেগুলো কখনোই তার নিজের মনে হতো না।
নারীর হাতে এ মুহূর্তে চারশো টাকা নেই। কিন্তু বাসা তো পাশেই। বাসায় কাপড়ের ভাঁজে এমন পাঁচশো-হাজার টাকা তার আছে। ইচ্ছে করলে সে এক-দেড় কেজি কইমাছ কিনতে পারে। সে জানে, ডেমরার বড়বাজারে গেলে ছয়শো টাকার নিচে সে এক কেজি কইমাছ পাবে না।
কিন্তু পরক্ষণ নারী কইমাছ কিনবে না বলে মত পাল্টে ফেলল। ভাবল, এই কইমাছ সে কার জন্য কিনবে, নিজের জন্য? এই সংসারে এসে নিজের শখ-আহ্লাদ বহু আগেই ত্যাগ করেছে। তাহলে সে কি স্বামীর জন্য কিনবে? ধ্যাৎ…! সে মাছওয়ালার পাশ কেটে সামান্য এগিয়ে বাসার গেইটের কাছে এসে দাঁড়াল। গেইট ঠেলে বাসার ভেতর ঢুকতে গিয়ে দেখল, কুকুরটা তখনো দরজার সামনে বসে আছে। তাকে দেখেই কুকুরটা শোয়া থেকে উঠে দাঁড়িয়ে শরীরের আড়মোড়া ভাঙল। একটু মেজাজ করেই ডেকে উঠল- কেঁউ-ও-ও…! নারী ভাবল, কুকুরটা সকালে এ বাসার পরোটা-ভাজি খেয়ে খেয়ে ভদ্রলোক হয়ে গেছে। অনেকটা তার স্বামীর মতোই। নাস্তার একটু উনিশ-বিশ হলে মেজাজ তালগাছে ওঠে। অথচ স্বামী ও তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন একসময় সকালে বাসি পান্তাভাতও ভাগে পেত না।
নারী কুকুরটাকে তাড়াল না। আজ সে কুকুরটাকের কোনোকিছু খেতেও দিবে না। সে নিস্পৃহভাবে দরজার তালা খুলে ভেতরে ঢুকল। মুদি দোকান থেকে আনা বাজার সদাইগুলো কিচেনের শেলফে রেখে দরজায় আবার তালা ঝুলিয়ে গেইট ঠেলে বের হলো। বাসা থেকে পশ্চিমের দিকে গলি ধরে গেলেই গলির মাথায় পুরাতন হাইওয়ে। পুরাতন হাইওয়ে ধরে দক্ষিণে এগোলে হাতের বামপাশ দিয়ে একটা পথ নেমে ডেমরার নতুন হাইওয়েতে গিয়ে ঠেকেছে। নতুন হাইওয়ের পাশে সারুলিয়া। দক্ষিণ খান গলিটা নতুন হাইওয়ে থেকে পুব দিকে সোজাসুজি গিয়ে নেমেছে। গলির মাঝামাঝি চারতলা দালানটা তৃতীয় পুরুষের।
নারী গেইট থেকে বের হয়ে সেদিকে হাঁটছে। মাঝেমাঝে সে হেঁটেই দক্ষিণ খান গলিতে তৃতীয় পুরুষের বাসায় চলে যায়। কিন্তু আজ রোদটা কাঠফাটা। যদিও সে রোদের বিপরীতে হাঁটছে। পথটা দীর্ঘ নয়। কিন্তু হাঁটতে গেলে কেমন দীর্ঘ হয়ে যায়। এছাড়া আজ মুদি দোকান থেকে বাজারসদাই নিতে গিয়ে তার বেশ দেরি হয়ে গেছে। তাই সে একটা রিকশা নিবে কিনা ভাবল। ভাবতে ভাবতেই সে সামনে একটা খালি রিকশা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল।
নারী জিজ্ঞেস করল, এই রিকশা যাবে?
রিকশাওয়ালা গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কই যাইবেন?
- নতুন হাইওয়ের পাশে, সারুলিয়া দক্ষিণ খান গলি।
- যামু। তয় তিরিশ ট্যাকা লাগব।
- তিরিশ টাকা, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?
- না আপা, মাথা ভালাই আছে। এর কমে যামু না।
- কেন, গত সপ্তাহেই দশ টাকা দিয়ে গেলাম, আজ তিরিশ টাকা?
- আপনে তিরিশ ট্যাকায় গেলে যান। নইলে অন্য রিকশা দেখেন।
- তুমি তো আচ্ছা বেয়াদব।
রিকশাওয়ালা বলল, হে হে হে, বেয়াদব আর যাই কন, আমি তিরিশ ট্যাকার নিচে যামু না।
নারী বলল, আমি তোমার রিকশায় যাব না, যাও।
রিকশাওয়ালা বিকারহীনভাবে অন্যদিকে তাকাল।
নারী কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে আবার রিকশাওয়ালার কাছে ফিরে এল। আশেপাশে কোনো রিকশা নেই। এমনিতে এই গলিতে রিকশা খুব কম থাকে।
নারী বলল, বিশ টাকা দেব। চল।
রিকশাওয়ালা একটা দাঁতাল হাসি দিয়ে বলল, আপনেরে দেইখ্যা নিতাছি। অন্য কেউ হলে তিরিশ ট্যাকার নিচে নিতাম না। ওঠেন।
নারী কিছু বলল না। সে রিকশায় উঠে বসল। এমনিতেই রিকশাওয়ালাদের প্রতি সে মনে মনে বেশ বিরক্ত। এরই মধ্যে ওদের ভণ্ডামো মার্কা কথাবার্তায় সে আরও বিরক্ত হয়। এখানে যদি আরও দু-একটা রিকশা থাকত রিকশাওয়ালা তিরিশ টাকা থাক দূরের কথা বিশ টাকাই হাঁকত না।
নারী রিকশায় ঠিক হয়ে বসে ভাবল, সত্যি তো সে পারতপক্ষে সাধারণ পুরুষ মানুষের সংস্পর্শে যায় না। মুদি দোকানদারকে তার মনে হয়, ছ্যাবলা। গলির শাড়ির দোকানদারকে মনে হয় মেনিবিড়াল। শাড়ির দোকানে গিয়ে সে ইচ্ছে করলেই একটা বাঁকা হাসি দিয়ে শাড়ির দাম অর্ধেক কমিয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু সে তাকে পাত্তা দেয় না। সে পাত্তা দেয় একজন কবি পুরুষকে। শিল্পী পুরুষের সংস্পর্শে নিজেকে জ্ঞানী মনে হয়। নায়ক পুরুষ বয়স্ক হলেও তার ভালোবাসায় এক ধরনের সৌন্দর্য আছে। রাজনীতিক পুরুষকে নিয়ে সে খানিকটা সন্দিহান হলেও গায়ক পুরুষ সবসময় তার নিজের পুরুষ। সে বরাবরই দ্রৌপদী হয়ে তার পঞ্চপুরুষের ভেতর নিজের সত্তা খুঁজে পায়।
রিকশাটা গলি ধরে ধীরে ধীরে যাচ্ছে। সিমেন্টের রাস্তার এখানেসেখানে ইট বের হওয়া। তাই রিকশার ঝাঁকুনি বেশি। অথচ হাঁটতে গেলে এতটা বোঝা যায় না। রিকশার ঝাঁকুনিতে নারীর বুক দুটো কাউকে দুই হাতে আহ্বান করার মতো ডাকছে। কিন্তু কাকে ডাকছে? নারী নিজের বুকের ঝাঁকুনির দিকে তাকিয়ে নিজেই লজ্জা পেল। বুকের আঁচলটা ঠিক আছে। তারপরও সে আঁচলটা টেনেটুনে ঠিক করল। রিকশার দুই পাশ দিয়ে গলি ধরে মানুষজন আসা-যাওয়া করছে। এদের কেউ তাকাচ্ছে, কেউ তাকাচ্ছে না। একজন ফেরিওয়ালা একটা খালি টুকরি মাথায় নিয়ে রিকশার সমান্তরালে হাঁটছে। অথচ সে হাঁক দিচ্ছে- এই কালা সাবান, এই কালা সাবান। রাখবেননি কালা সাবান…! নারী হঠাৎ আবিষ্কার করল, রিকশাটা একটু জোরে চললে ফেরিওয়ালা দৌড়ের মতো করে হাঁটা শুরু করে, আবার রিকশাটা আস্তে চলতে শুরু করলে সে হাঁটার গতি শ্লথ করে। সে চেষ্টা করছে রিকশার সমান্তরালে হাঁটতে।
নারী বুঝতে পারল, ফেরিওয়ালা তার বুকের কাঁপুনি দেখার জন্য এমনটা করছে। সে রিকশার হুড তুলে দিল। কিন্তু এতেও রক্ষা হল না। ফেরিওয়ালা এবার রিকশার গা ঘেঁষে ঘেঁষে হাঁটছে।
নারী কয়েকবার বিরক্তিতে তাকাল। একবার গলা বাড়িয়ে ক্ষেপে উঠল, এই আমার রিকশার পাশে পাশে এমনে হাঁটছ কেন?
ফেরিওয়ালা জবাব না দিয়ে আরও জোরে হেঁকে উঠল- এই কালা সাবান, এই কালা সাবান। রাখবেননি কালা সাবান…।
নারী আবার কিছু বলতে যাবে এর আগেই রিকশাওয়ালা খেঁকিয়ে উঠল, ওই কালা সাবানওয়ালা, তোর টুকরিতে তো সাবান নাই। তুই কোন মতলবে আমার রিকশার লগে লগে হাঁটতাছস?
কালা সাবানওয়ালা জবাব দিল না। দাঁত কেলিয়ে হাসল।
রিকশাওয়ালা একটু ক্ষেপে উঠে বলল, যা ভাগ। নইলে রিকশা থামাইয়া তোর নাক ফাটাইমু। লওয়ের পুত, মাইয়ামানুষ দেখলে হুঁশ থাকে না…!
ফেরিওয়ালা আবার ডেকে উঠল, এই কালা সাবান। কা-লা সাবান…।- বলতে বলতে সে পিছিয়ে গেল।
রিকশাওয়ালা বলল, আপা, এইগুলার লাইগ্যাই আমাগো বদনাম হয়।
নারী কিছু না বলে সায় দিয়ে মৃদু হাসল।
রিকশাটা পুরাতন হাইওয়েতে উঠে এল। ডেমরার ওপাশ দিয়ে নতুন হাইওয়ে হওয়ার পর পুরাতন হাইওয়েতে আজকাল যানবাহন বা মানুষজনের তেমন ভিড় হয় না। এতে রাস্তার অর্ধেকটা জুড়ে হকার বা দোকানি বেড়ে গেছে। বিশেষ করে বিকেলের দিকে কাঁচামালের পসরা বসে বেশ।
রিকশাটা পুরাতন হাইওয়ে ধরে খানিকক্ষণ গিয়ে বামের একটা রাস্তা ধরল। ওটাকে রাস্তা বললে অবশ্য ভুল হবে। আরেকটা গলিই বলা যায়। গলির মাথাতে এসে নতুন হাইওয়েতে উঠতেই অনেকগুলো সিএনজি চোখে পড়ল। সিএনজিগুলো থেমে আছে। কিন্তু হাইওয়ে বাসগুলো বেশ দ্রুত আসা-যাওয়া করছে। রিকশাওয়ালা বেশ সতর্কভাবেই নতুন হাইওয়েটা পার হল। নতুন হাইওয়ে পার হতেই সারুলিয়ার দক্ষিণ খান গলি।
দক্ষিণ খান গলির ঠিক মাঝামাঝি চারতলা বাড়িটা তৃতীয় পুরুষের। চারতলা বাড়ির দোতলার পুরোটা নিয়ে তৃতীয় পুরুষ থাকেন। তিনি একাই থাকেন। এতবড় বাসা তার প্রয়োজন নেই। কিন্তু নিজের বাড়ি, পুরো দোতলাটা নিয়ে তিনি একা থাকতেই পারেন।
নারী গাড়ির গ্যারাজ পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে কলিংবেল বাজাল। সে ভেতরে বেল বাজার শব্দ শুনল- টুইট-টুইট, টুইট-টুইট। কিন্তু ভেতর থেকে কারও সাড়াশব্দ পেল না। সে মনে মনে ভাবল, বেশি দেরি করে ফেলেনি তো?
নারী আবার কলিংবেল বাজাল। আবারও ভেতর থেকে পাখির শব্দ নিয়ে বেল বাজল- টুইট-টুইট, টুইট-টুইট।
তৃতীয় পুরুষ এবার দরজা খুললেন। দরজা খুলেই তিনি নারীকে দেখে একটা দিঘল হাসি দিলেন। বললেন, এসো, ভেতরে এসো।