ঈশ্বর
মহিবুল আলম
।। তিন ।।
স্বামী এ রকমই। সে বরাবরই নারীকে সোহাগ করতে গিয়ে করুণা করে। দেহের নিচে রেখে কেমন উদাস দৃষ্টি মেলে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে সটান হয়। যেন প্রতিদিনের ঝগড়ার মতোই ব্যাপারটা ঘটে যায়।
অথচ নারী যে অসুন্দরী তা নয়। বরং বলা যায় অপূর্ব সুন্দরী। তার বাবা তাকে পদ্মাবতী কন্যা বলে ডাকতেন। নারী জানে, সে এমন অপূর্ব রূপবতী বলেই চালচুলোহীন বাবার কন্যা হয়েও সরকারি ঘরের এই বড় কামলার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে।
নারী প্রায়ই স্বামীর সঙ্গে তার পাঁচ প্রেমিকের তুলনা করে। কিন্তু সে হতাশ হয়। স্বামী অফিসে চলে গেলেই তার সামনে অফুরন্ত সময় এসে ভিড় করে। বড্ড স্বস্তির সময়। যদিও স্বস্তির সময়, কিন্তু বেলা হননের পালায় তার মধ্যে বিজাতীয় উত্তেজনা এসে ভিড় করে।
নদী ও মাঝি দেখতে দেখতে নারী মেঘনার পাড়ে বেড়ে উঠলেও গ্রামের সেই সঙ্কোচবোধ শহরে এসেও তার প্রথম এক-দুই বছর যায়নি। প্রথম প্রথম স্বামী অফিসে চলে গেলে সে বাসার ভেতর আড়ষ্ট হয়ে বসে থাকত। বাসায় একটা টেলিভিশন আছে। রঙিন টেলিভিশন। কিন্তু সে টেলিভিশন ছাড়ত না। বাসায় বসেই সে রোদ দেখত, বৃষ্টি দেখত ও বেলা হননের পালা গুনত। শীত যায় যায় করে দরজার সামনে রোদ এসে পড়ত। কখনো রোদ দরজা গলে ভেতরেও ঢুকে যেত। বসন্তকালটা সে এখানে মোটেও খুঁজে পেত না। গ্রীষ্মের ভ্যাপসা গরমে হাঁপিয়ে উঠত। বাসার সিলিং ফ্যানটা তখন শব্দ করে ঘুরত- ক-য়-ট, ক-য়-ট, ক-য়-ট। পরে অবশ্য ফ্যানটা পরিবর্তন করা হয়। বর্ষায় কখনো বৃষ্টি হত, কখনো হত না। বৃষ্টি হলে বাসার সামনের ছোট্ট লনটায় শ্যাওলা-কাদায় থকথক করত। সে এসব দেখতে দেখতে বিকেল করত। সন্ধ্যায় স্বামী অফিস থেকে ফিরত।
স্বামী অফিস থেকে ফিরেই শার্টপ্যান্ট খুলে, বিশাল ভুঁড়ির ওপর লুঙিটা ঠিকমতো গিঁট না দিয়ে পরে সোফায় গা ছেড়ে দিয়ে বসত। টেলিভিশনটা চালু করত ঠিকই, কিন্তু সে টেলিভিশনের কোনো প্রোগ্রামের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে বিশাল ভুঁড়িটা বের করে, কখনো সেই ভুঁড়িটায় একহাত বুলাতে বুলাতে, কখনো বা টাক মাথায় হাত ঘষতে ঘষতে অন্যহাতে মোবাইল কানে নিয়ে অনবরত কথা বলত। মাঝেমধ্যে অফিসের কোনো ঘটনা নিয়ে হেসে উঠত- ফ্যাঁ-ফ্যাঁ, ফ্যাঁ-ফ্যাঁ। স্বামীর এ অবস্থায় নারী এসে অনুরোধ করত, শুনছো, ঘরে আটা নেই। সকালে পরোটা বানাবো কীভাবে…? লবণও নেই, আলু নেই, ভাজি বা তরকারি রান্না করতে হবে…। চাল নেই, দুপুরে রান্না করবো কী…? মশার যন্ত্রণায় বসা যায় না। একবাক্স কয়েল না হলেই নয়। বয়ামে একচামচও চা-পাতি নেই। দোকানে না গেলেই যে নয়…!
স্বামী তখন স্বভাবের চণ্ডালে খেঁকিয়ে উঠত। গায়ের গেঞ্জিটা ভুঁড়ির ওপর টেনে নামিয়ে লুঙির গিঁট বাঁধতে বাঁধতে বলত, অতিষ্ঠ, অতিষ্ঠ!
সেই থেকে নারীর বাসার বাইরে যাওয়া শুরু।
দিঘল গলিতে সারি সারি দোকানে মাঝে একটা বড় মুদি দোকান। সেই মুদি দোকানে বা দোকানে আসা-যাওয়ার পথেই একে একে তার পাঁচ প্রেমিকের সঙ্গে পরিচয়।