ঈশ্বর
।। ছয়।।
প্রথম পুরুষ যে কোনো কারণেই হোক বিরক্ত। তার সেই বিরক্তি নারীর ওপর নয়। বরং সে নারীকে পেয়ে বেশ খুশিই হয়েছে।
নারী একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার কবি, এত গম্ভীর কেন? কোনো কারণে কি মন খারাপ? কবিদের এমন মন খারাপ করা চেহারা কি মানায়?
প্রথম পুরুষ মৃদু হেসে বলল, হ্যাঁ, খানিকটা।
- আমি এসেছি বলে বিরক্ত হওনি তো?
- আরে নাহ। তুমি আসাতে বরং মনটা ভালো হয়ে গেছে। কিছু কথা শেয়ার করতে পারব।
- তাই, কী কারণে তোমার মন খারাপ?
- সে অনেক কারণ।
- কারণগুলো কি বলা যাবে?
- অবশ্যই বলা যাবে। আমার শুধু মন খারাপ না, মেজাজও খারাপ।
- কী হয়েছে বলবে?
- বলব, অবশ্যই বলব। তুমি আজ সময় নিয়ে এসেছ তো?
- হ্যাঁ, আগামি শুক্রবার বা শনিবারে দুই সপ্তাহের জন্য গ্রামের বাড়ি যাব।
- তোমার তো কপাল। গ্রামের বাড়িতে ঈদ করবে। কী মজাই না হবে…।
- মজা? জানি না। গ্রামের বাড়িতে মজা করার জন্য ঈদ করতে যাই না। ওটা আমাদের বাড়ি না। স্বামীর গ্রামের বাড়ি। যতদিন স্বামী আছে, আমাকে সেখানে যেতেই হবে।
- ওই, একই কথা।
- না, এককথা নয়। তোমাকে তা অনেকবারই বলেছি।
প্রথম পুরুষ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে। মানলাম যে এক কথা না। ওসব কথা বাদ দাও। এখন বলো, সকালের নাস্তা কি করে এসেছ, নাকি এখানে করবে?
নারী কৃত্রিম কটাক্ষ করে বলল, তুমি মনে হয় আমার জন্য সবসময় নাস্তা বানিয়ে রাখ?
প্রথম পুরুষ হেসে ফেলল, হা হা, হা হা। বলল, তা অবশ্য বানিয়ে রাখি না। আমি কি নিজের জন্য নাস্তা বানাই? গলির রেস্টুরেন্টগুলো কার জন্য? - হুম, মন্দ বলোনি।
- এখন বলো, নাস্তা করবে তো?
- তুমি কি গলির রেস্টুরেন্ট থেকে এনে আমাকে নাস্তা করাতে চাচ্ছ?
- অসুবিধা কি?
- নাহ, কোনো অসুবিধা নেই। তবে আপাতত ওটার প্রয়োজন নেই। আমি নাস্তা করেই এসেছি। তুমি নাস্তা করেছ?
- নাহ। বের হব ভাবছিলাম। এরই মধ্যে তোমার ফোন আসে। আমার অবশ্য তেমন ক্ষুধা নেই। বাসায় টোস্ট বিস্কুট আছে। চা দিয়ে টোস্ট বিস্কুট খেলেই চলবে। একেবারে লাঞ্চ করব।
- কবি মানুষরা বুঝি এমনই হয়। খাওয়াদাওয়ায় অবহেলা করে।
- তুমি আজ বুঝলে?
- না, অনেক আগেই বুঝেছি।
- ভালো। তুমি কি চা-টা খাবে?
- তুমি এমনভাবে বললে খাব না। ভালোভাবে বললে খাব।
প্রথম পুরুষ আবার শব্দ করে হেসে ফেলল, হা হা, হা হা। বলল, আচ্ছা, ঠিক আছে। তোমাকে ভালোভাবেই বলছি, প্রিয়তমা, প্রাণেশ্বরী, তুমি কি চা খাবে?
নারীও মিহি শব্দ করে হেসে ফেলল। বলল, জি প্রিয়তম, প্রাণেশ্বর…!
প্রথম পুরুষ মাথা ঝাঁকিয়ে হেসে কিচেনে চলে গেল।
নারীও কিচেনের দিকে এগিয়ে গেল। তবে কিচেনের ভেতরে ঢুকল না। দরজার কাছেই হেলান দিয়ে দাঁড়াল।
প্রথম পুরুষ গ্যাসের স্টোভ জ্বালিয়ে চায়ের ছোট্ট ডেকচিটা বসিয়ে দিল।
নারী বলল, তুমি কোন দিন যে একটা কেটলি কিনবে? এখনো ডেকচিতে চা বানাও!
প্রথম পুরুষ মৃদু হেসে বলল, তুমি টাকা দাও। তোমার স্বামী তো সরকারি চাকরি করে। তাও আবার ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টে। ওরে বাব্বা, তোমার স্বামী যা ঘুষ খায়! তোমরা কেন যে এসব চিপাগলির ছোট্ট বাসায় থাক? - আমাদের বাসাটা ছোট নয়। দুটো বড় বেডরুম। একটা ড্রয়িংরুম। আলাদা কিচেন। আমরা দুজন মাত্র মানুষ।
- হুম, আজ দেখছি স্বামীর পক্ষে সাফাই গাইছ?
- না, মোটেও না। যা সত্য, তা বলছি।
- বেশ ভালো। কিন্তু একটা কথা। তোমার স্বামী এত ঘুষ খায়। সেই টাকাগুলো কই?
- কেন, হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?
- না মানে, ট্যাক্স অফিসের একজন দারোয়ানেরও ঢাকা শহরে নিজের দুই-তিনতলা দালান আছে। তোমার স্বামী তো ওখানে বেশ ভালো পোস্টেই চাকুরি করে। তার বাড়ি নেই কেন?
- জানি না।
- তুমি তাকে কখনো জিজ্ঞেস করনি?
নারী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তোমাকে তো অনেকবারই বলেছি। আমার স্বামীটা জিজ্ঞেস করার মতো কোনো মানুষ নয়।
প্রথম পুরুষ সায় দিয়ে শব্দ করল, অ!
চায়ের পানির বলক ওঠা শুরু হয়েছে। এক ধরনের শব্দ করছে- ব-ল-ল-ল, ব-ল-ল-ল, ব-ল-ল-ল।
প্রথম পুরুষ একটা বয়াম থেকে পরিমাণমতো চা-পাতা দিল।
নারী প্রথম পুরুষ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বাইরে তাকাল। জানালার ওপাশে একটা নারিকেল গাছ। গাছটার চিরল পাতাগুলো তিরতির করে কাঁপছে। বাইরে মৃদুমন্দ বাতাস বইছে।
নারিকেল গাছটা বাসার দোতলার সমান উঁচু। যদিও নতুন গজিয়ে ওঠা ডগাটা খাঁড়া সরু হয়ে দোতলা ছাড়িয়ে গেছে, তারপরও জানালা গলে এক ফালি রোদ বাসার ভেতর এসে পড়েছে। অসংখ্য ত্রসরেণু সেই রোদের রশ্মিতে ভাসছে।
নারী বলল, আজ দিনটা খুব সুন্দর। চমৎকার রোদ উঠেছে। কিন্তু ভ্যাঁপসা গরম নেই।
প্রথম পুরুষ কাপে চা ঢালতে ঢালতে বলল, হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। গত কয়েকটা দিন বেশ ভ্যাঁপসা গরম গেছে। জ্যৈষ্ঠমাসের গরম। - হুম, ওদিকে আমাদের ড্রয়িংরুমের পাখাটা বদলানো দরকার। শব্দ করতে শুরু করেছে- কট কট, কট কট। আগের পাখাটার মতোই।
- কয়েক মাস আগে না বদলিয়েছ?
- হ্যাঁ, সস্তার ফ্যান কিনলে যা হয়।
- তোমাদের সস্তা ফ্যানের শব্দটা কি আমার খাটটার শব্দের মতো?
নারী বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, কী বললে?
প্রথম পুরুষ দুষ্টামির হাসি হেসে বলল, ওই যে, আমরা যখন প্রেম করি, তখন খাটটা কেমন শব্দ হয়- কট কট, কট কট…!
নারী কৃত্রিম চোখ পাকিয়ে বলল, অসভ্যতা করছ? তাইলে কিন্তু…! - কিন্তু কী?
- কিছু না।
প্রথম পুরুষ জোরে হাসল- হা হা, হা হা। বলল, আচ্ছা ঠিক আছে। এখন বলো, চায়ে কয় চামচ চিনি খাবে?
নারী অবাক হওয়ার কৃত্রিম ভান করে বলল, তুমি তো অবাক মানুষ!
প্রথম পুরুষ জিজ্ঞেস করল, সেটা কেমন? - আমি প্রায় তিন বছর ধরে তোমার বাসায় আসি। আমি এলে তুমি প্রায়ই চা বানাও। কিন্তু আজ হঠাৎ চায়ে চিনির কথা জিজ্ঞেস করছ?
- আজ তুমি সবুজ শাড়ি পরেছ যে?
নারী নিজের শাড়ির দিকে তাকাল। বলল, তাতে কি?
প্রথম পুরুষ মিটমিট করে হেসে বলল, আজ সবুজ শাড়িতে তোমাকে সম্পূর্ণ নতুন মানুষ লাগছে। তাই নতুন মানুষটাকে নতুন করে চায়ের চিনির কথা জিজ্ঞেস করছি। - কাব্য করছ?
- হা হা, হা হা…! তা বলতে পার। সবুজ শাড়িতে তোমাকে সত্যি সবুজ পরির মতো লাগছে। আর দেখ দেখ, বাইরের সোনালি রোদটা তোমার পায়ের কাছে পড়ে কেমন কুর্নিশ জানাচ্ছে।
নারী রোদটুকুর দিকে তাকাল।
প্রথম পুরুষ তৎক্ষণাৎ একটা কবিতা বলতে শুরু করল।–
…নারী, তুমি সেজদায় আঁখি ওঠা বুক
কাজল চোখের নেশা ঢেলে কৈরবে আনত হও
ভূমি কাঁপে, মুনি কাঁপে, ধরণি রমণী হয়
তুমিও নারীর আদলে অস্পরা হও, দেবীমুখ
ঈশ্বরের প্রণাম লও…।
নারী চুপ হয়ে গেল। প্রথম পুরুষের সঙ্গে তার পরিচয়ের কথা মনে পড়ে গেল। নির্বোধ দোকানদারের মুদি দোকানেই প্রায় তিনবছর আগে প্রথম পুরুষের সঙ্গে তার পরিচয়। প্রথম পুরুষ সেদিনও তার চোখে তাকিয়ে কয়েক লাইনের একটা কবিতা বলে ওঠেছিল।
…চোখের অপূর্ব নেশায় হিজল গাছের একটা দীর্ঘছায়া পড়ে
কেমন চিত্রল ছায়ায় রমণী একাকী দাঁড়িয়ে
সে একাকী নয়, ছায়া ও দিঘল ছায়ায় তার চোখে অসম্ভব স্বস্তি।
নারী, তুমি হাতটা বাড়াও, চুপ করে থেকো না
কোন পুরীর তুমি? পাতালের নাকি স্বর্গ নামক যন্ত্রণার?
আমি তোমাকে ঠিকই চিনে নিবো…।