ঐতিহ্যবাহী মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব এবার নবরূপে সেজে উঠেছে। বদল এসেছে ক্লাবের পরিচালন সমিতিতে। স্বদেশি-বিদেশি মিলিয়ে তুখোড় টিম গড়েছেন নতুন কর্তারা। সেই সব-ই খেলোয়াড়দের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে ‘নিউজ পিডিয়া’।
কলমেঃ- মোস্তাফিজুর রহমান।
আজঃ শৌভিক ঘোষ।
★নাম-শৌভিক ঘোষ।
★ডাক নাম -সন্তু।
★বাড়ি-বালি,হাওড়া।
★বয়স-২৭।
★ওজন-৭১কেজি।
★উচ্চতা-৫ ফুট ১১ ইঞ্চি।
★পজিশন- স্টপার/লেফট্ ব্যাক।
★পছন্দের ভারতীয় ফুটবলার-দীপক মন্ডল।
★পছন্দের বিদেশি ফুটবলার-লিও মেসি।
★লক্ষ্য-নিজেকে ৯০ মিনিট খেলার মতো ফিট রাখা আর অবশ্যই টিমকে আই লিগের মূলপর্বে তোলা।
★স্বপ্ন-মহামেডানের হয়ে খেলতেই খেলতেই যেন ডাক পান ভারতীয় দলে।
★অবসর সময়-ছেলের সাথে খুনসুঁটি।
বাঙালীর আবেগ তো আছেই।তাই যখনই শুনেছিলাম শৌভিক ঘোষ মহামেডানে সই করেছে খুব খুশি হয়েছিলাম। যতই হোক বাংলার ছেলে বাংলার ক্লাবে খেলবে, এটাই তো কাম্য। আর পাঁচটা ফুটবলারের মতোই ছেলে বেলা থেকে ফুটবলের নেশা ছিল। এদিকে বাবা দেবকুমার ঘোষ এক প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করে সংসারের খরচ চালাতে হিমশিম অবস্থা।
তাই নিজের মনের ইচ্ছাটা বাবাকে বলার সাহস পেলেন না, মায়ের কোলে বসে আদর জড়ানো কন্ঠে আবদার করলেন একটা ফুটবল কিনে দেওয়ার জন্যে। মা’ও ফেলতে পারলেন না আদরের একমাত্র সন্তান ‘সন্তু’র কথা। বাবাকে রাজি করিয়ে কিনে দিলেন একটা ফুটবল।
ব্যস, আর যায় কোথায়! ফুটবল ধ্যান, ফুটবল জ্ঞান। ফুটবল চিন্তামণি। ফুটবল ছাড়া শৌভিক যেন মণি হারা ফণী।’
এর জন্য বকা খেতে হয়নি,তা নয়। তথাপিও কে পাত্তা দেয় তখন ওসব কথা। তবে,অন্যান্য বাঙালি মায়ের ধারণার মতো, শৌভিকের মায়ের ধারণা একই ছিল না। তিনি এটা মনে করতেন, কোনো কাজই ফেলনা নয়। নিজের একশো শতাংশ দিতে পারলে আর অধ্যাবসায় থাকলে,সাফল্য আসবেই। তাই মা দেবীকা দেবী, বাংলার ফুটবলার তৈরির ‘আঁতুড় ঘর’ বালির নেতাজি ব্রিগেডে কোচ অনুপ নাগ-এর কাছে ছেলেকে ফুটবলের পাঠ নেওয়ার জন্য ভর্তি করলেন।
যেখান থেকে উঠে এসেছেন প্রীতম, প্রণয়, অরিজিত, সামাদ আলি, তীর্থঙ্করের মতো একঝাঁক ভারতীয় তারকা। শৌভিক নিজেও যথেষ্ঠ প্রতিভাবান এবং সফল খেলোয়াড় সন্দেহ নেই। ২০১৫ সালে মোহনবাগানের হয়ে আই লিগ জয়েও তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। যাই হোক, শৌভিক নেতাজি ব্রিগেড থেকে চলে যান উয়াড়ি। সেখান থেকে গরলগাছার হয়ে দু-মরসুম খেলার পর বাংলার অনূর্ধ্ব ১৯ দলে ডাক পান। অতঃপর, ময়দানের অন্যতম সফল কোচ তনুময়ের সুপারিশে কলিন টোল-এর কোচিংয়ে অনূর্ধ্ব ১৯ ভারতীয় দলেও বেশ দাপটের সঙ্গে খেলেন।
ভারতীয় দলে ভালো খেলার সুবাদে তৎকালীন চিরাগ ইউসাইটেড’এর কোচ সুব্রত ভট্টাচার্য তাকে দলে নেন। কিন্তু,মরসুমের শেষের দিকে আসার জন্য তেমন ভাবে সুযোগ পাননি। এর মধ্যে পৈলান অ্যারোজে ডাক পাওয়ায় সেখানে চলে যান। তারপরের কাহিনী সবাই মোটামুটি জানেন। কিভাবে মোহনবাগানের হয়ে আই লিগ জেতেন। যদিও চোটের কবলে সব ম্যাচ খেলতে পারেননি।কিন্তু,নিজের জাত চেনাতে ভুল করেননি। তাই তো তাঁকে তুলে নেন আইএসএলের দল নর্থইস্ট ইউনাইটেড।
এরপর আইএসএলের বিভিন্ন দল, যেমনঃ- জামসেদপুর,মুম্বই সিটি এফ সি হয়ে মহামেডান স্পোর্টিংয়ে আগমন। তাঁর আগমনে মহামেডান কতটা উপকৃত হবে, সেটা তো সময়ই বলবে। কিন্তু শৌভিক ঘোষ যে এবার মহামেডানের তুরুপের তাস হতে যাচ্ছে কোনো সন্দেহ নেই। তো সেই শৌভিককে ফোন করে বেশ কিছু কথা হলো ফোনে অকপট শৌভিক!
প্রশ্নঃ লকডাউনে নিজেকে ফিট রাখছো কিভাবে?
উত্তরঃ মাঠে সেভাবে নামা হচ্ছে না। তবে নিয়মিত জিম করছি। ইনডোর প্র্যাকটিস করছি আমাদের কোচ চিরুদা’র (চিরঞ্জিত) কাছে।
প্রশ্নঃ হঠাৎ কেন মহামেডানে খেলার সিদ্ধান্ত নিলে? যেখানে আইএসএলে টাকার কাঁড়ি?
উত্তরঃ আসলে আমি একটা নতুন ক্লাব খুঁজছিলাম। মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের তীর্থঙ্কর আমার খুব ভালো বন্ধু, তাকেও বলি ভালো একটা ক্লাবের খোঁজ দেওয়ার জন্য।তখন তীর্থ (তীর্থঙ্কর)আমাকে মহামেডানে সই করার জন্য পরামর্শ দেয়।
প্রশ্নঃ কিন্তু তুমি আইএসএল থেকে একেবারে দ্বিতীয় ডিভিসন?
উত্তরঃ আসলে পেশাদার ফুটবলে সব ক্লাবই সমান। তাছাড়া, মহামেডান ভারত বর্ষের অন্যতম সেরা ও ঐতিহ্যশালী ক্লাব। সুতরাং, সেখানে খেলা গর্বের ব্যাপার তো বটেই!
প্রশ্নঃ তাহলে কি ঐতিহ্যের কথা মাথায় রেখেই মহামেডানে?
উত্তরঃ ওটা তো অবশ্যই বড় একটা কারণ। তাছাড়াও, আমি বিদ্যুৎ পর্ষদে চাকরি করি, সেক্ষেত্রেও সুবিধা হবে আর পরিবারকেও সময় দিতে পারবো।
প্রশ্নঃ বেশিরভাগ খেলোয়াড়ের-ই বাবা, দাদা’র হাত ধরে খেলার মাঠে প্রবেশ ঘটে। তোমার ক্ষেত্রে ভিন্ন! মায়ের হাত ধরে! মায়ের অনূভুতি কেমন?
উত্তরঃ আসলে মা আর নেই। ২০১২ সালে পরলোক গমন করেছেন।
প্রশ্নঃ বাবা কি রকম সাপোর্ট করেন?
উত্তরঃ বাবা এমনিতেই ফুটবল ভালোবাসেন। মোহনবাগানের অন্ধভক্ত। সুতরাং, ছেলে যদি ভালো খেলোয়াড় হয়, তাতে তো উৎসাহ থাকবেই।
প্রশ্নঃ বাবা মোহনবাগান সমর্থক। যদি মহামেডান বনাম মোহনবাগান খেলা হয়, তাহলে বাবা কাকে সমর্থন করবেন?
উত্তরঃ আসলে সমর্থনটা মন থেকে হয়। প্রকৃত সমর্থক যারা হয়, তারা নির্দিষ্ট একটা দলকেই সমর্থন করে। তবে, বাবা যদি মোহনবাগানকে সমর্থন করেও, আমি কিন্তু মোহনবাগানকে মাঠের মধ্যে এক ইঞ্চিও জমি ছাড়বো না।
প্রশ্নঃ ক্যারিয়ারে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব মুহুর্তে চোট।কতটা ভেঙ্গে পড়েছিলে?
উত্তরঃ ভেঙ্গে পড়িনি।তবে একটু পিছিয়ে পড়েছিলাম। সেই সময় আমার স্ত্রী খুব করে পাশে ছিল। সাহস দিতো। তাই আবার মাঠে ফিরতে পারি।
প্রশ্নঃ লাভ ম্যারেজ নাকি অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ?
উত্তরঃ (হাঁসি) লাভ ম্যারেজ। বলতে পারেন প্রথম দর্শনেই প্রেম!
প্রশ্নঃ মানে?
উত্তরঃ পাড়ার একটা বিয়ে বাড়িতে প্রথম দেখেই প্রেমে পড়ে যাই। অতঃপর প্রেম পরিণতি পায়।
প্রশ্নঃ এবছর মহামেডান সমর্থকদের কি বার্তা দেবে?
উত্তরঃ সমর্থকরা এখন যথেষ্ঠ বাস্তববাদী। শুধু অনুরোধকরবো, পাশে থাকুন।ভরসা রাখুন। হতাশ করবো না।
প্রশ্নঃ নতুন কর্তাদের নিয়ে কিছু বলবে?
উত্তরঃ অবশ্যই ভালো কাজ করছেন।সমর্থকদের সাথে একাত্ম হয়ে মিশছেন।সমর্থকদের আবেগের গুরুত্ব দিচ্ছেন। সুতরাং ভালো তো বলতেই হবে।।
শেষ প্রশ্ন করতে যাবো, এমন সময় তাঁর ছোট্ট ছেলে পাশ থেকে বলে উঠলো,
‘বাবা! মা অপেক্ষা করছে খাবে এসো!’ আমিও কথা বাড়ালাম না।
তবে, শুধু শৌভিকের স্ত্রী নয়, তার পারফরম্যান্সের অপেক্ষায় অগণিত মহামেডান সমর্থকও।