ওহিদ রেহমান
সময়টা ১৯৬৮ সালের ২০ মে। সুইডেন সরকার রাষ্ট্রসংঘের অর্থনীতি ও সামাজিক পরিষদের কাছে একটি চিঠি লিখল। চিঠির বিষয়বস্তু ছিল, প্রকৃতি ও পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে তাদের গভীর উদ্বেগের বর্ণনা। বিষয়ের গভীরতা উপলদ্ধি করে রাষ্ট্রসংঘের তরফে পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি সাধারণ অধিবেশনের আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এবং ঠিক হয় যে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে ১৯৭২ সালের ৫ থেকে ১৬ জুন রাষ্ট্রসংঘ মানব পরিবেশ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। সেই সভায় অংশগ্রহণ করে ১১৯ টি দেশ। সভায় ঘোষণা করা হয় পৃথিবীর সঙ্গে পরিবেশের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। সভ্যতার বিকাশ যেন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অন্তরায় না হয়ে পড়ে। তারপর ১৯৭৪ সাল থেকে প্রতিবছর ৫ জুন ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ বিশ্বব্যাপী পালন করা হয়।
বর্তমানে সারা বিশ্ব কোভিড-১৯ এর তাণ্ডবে ঘরবন্দী। মানুষের সকল কর্মকাণ্ড থমকে গিয়েছে। এই দুর্দিনে প্রকৃতির ভয়াবহ রূপ ক্রমশ স্পষ্ট। এই বাস্তবতা থেকে নতুন করে শিখতে শুরু করেছে মানুষ। তবে সেই শিক্ষা করোনার পরও থাকবে কিনা সেটিই দেখার বিষয়। চলতি বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসের মূল প্রতিপাদ্য ‘Time for Nature’। অর্থাৎ এখন সময় প্রকৃতির। দিনটি পালনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, পরিবেশ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো।
জলবায়ু, পরিবেশ এবং মানুষ একে অপরের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে যুক্ত। প্রত্যেকটি জীব প্রজাতির মধ্যে রয়েছে অত্যন্ত নিবিড় পারস্পরিক সম্পর্ক। মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনের প্রায় সব কিছুই পরিবেশ থেকে সংগ্রহ করে। আবার এই মানুষই তার প্রয়োজনে এবং অপ্রয়োজনে সব থেকে বেশি ক্ষতিসাধন করে পরিবেশের। বস্তুত, এই দিনটি পালনের মূল লক্ষ্য পৃথিবীর বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে সভ্যতার বিকাশ করা যায়, তার রূপরেখা গঠন।
এবার পরিবেশ দিবসের আয়োজক দেশ কলম্বিয়া। জার্মানির সঙ্গে তারা মিলিতভাবে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে। তবে লকডাউনের জন্য পুরো আয়োজনই হবে ভার্চুয়াল। সারা বিশ্বের জীববৈচিত্র্যের ১০ শতাংশই রয়েছে কলম্বিয়াতে। অ্যামাজনের একটি বড় অংশও রয়েছে কলম্বিয়ায়। এই অ্যামাজনেই বছরের পর বছর আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকার বনভূমিতেও গত বছর ভয়াবহ আগুন লাগে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জীববৈচিত্র্য রক্ষার যে তাগিদ দুনিয়াব্যাপী আলোচিত হচ্ছে, মানুষের অতিপ্রয়োজনীয়তা তাতে বাদ সাধছে। বর্তমানে, করোনা ভাইরাস মানুষের সেই অতিপ্রয়োজনীতা কমিয়ে জীববৈচিত্র্য রক্ষা করছে।
লকডাউন উত্তর বিশ্বে পরিবেশ নিয়ে রূপরেখা তৈরি করতে হবে আমাদের তাগিদেই। চলমান বিশ্ব উষ্ণায়ন আমাদের সভ্যতাকে চ্যালেঞ্জ করছে প্রতিমুহূর্তে। মানুষ যতই আধুনিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হচ্ছে, পরিবেশের উপরে ততই চাপ পড়ছে। এর ফলে বাড়ছে কল কারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া এবং বর্জ্য। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য, বাসস্থান এবং অন্যান্য চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে বিলুপ্ত হচ্ছে জঙ্গল, নদী-নালা, খাল-বিল। সেই সঙ্গে বিলুপ্ত হচ্ছে এসব স্থানে বসবাসকারী বিভিন্ন ছোট বড় প্রাণী। আমাদের অতিরিক্ত গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমনের ফলে শ্বাসযোগ্য বায়ুর অবনতি হচ্ছে দিন দিন। আমরা যদি সদর্থক সিধান্ত গ্রহণ না করি তাহলে এমন দিন হয়তো আর বেশি দূরে নয়, যখন পিঠে অক্সিজেনের সিলিন্ডার বেঁধে আমাদের চলতে হবে। তাই এখনই চাই কিছু জরুরি পদক্ষেপ।
আসুন, সবাই বেশি বেশি করে গাছ লাগান। গাছ নিজের প্রাণের বিনিময়ে এই সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখে। বুক চিতিয়ে লড়ে টর্নেডো, টাইফুন কালবৈশাখীর সঙ্গে। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গাছ অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বর্জন করুন প্লাস্টিকের ব্যবহার। প্লাস্টিক ক্ষতিগ্রস্ত করছে আমাদের ভূগর্ভস্থ পরিবেশ। প্লাস্টিক জলের নীচে থাকা প্রাণের জন্য অন্যতম হুমকি।
সামাজিক ভাষ্যকারদের অভিমত, পৃথিবীতে পরবর্তী লড়াই হয়তো বা পানীয় জলের জন্য। তাই, জলের অপচয় বন্ধ করুন। দিন দিন আমাদের
ভূগর্ভস্থ জলস্তর নামছে। তাই, বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করুন।
ব্যক্তিগত গাড়ির পরিবর্তে গণ পরিবহন ব্যবহার করুন। মনে রাখবেন, আপনার সামাজিক অবস্থান শুধু চার চাকার গাড়িতেই সীমাবদ্ধ নয়, তা আপনার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির উপরও নির্ভর করে। এর ফলে বায়ুদূষণ কমবে।
আসুন, কয়লার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করি। কয়লার ব্যবহার বাতাসে ভরিয়ে তুলছে অতিরিক্ত কার্বন। বায়ুদূষণ হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত। তাই আসুন, তার পরিবর্তে সোলার পাওয়ার বা উইন্ড পাওয়ারের মতো অচিরাচরিত শক্তির ব্যবহার করি।
আসুন হাতে হাত রেখে সদর্থক শপথ নিই। ব্যক্তি জীবনের আর পাঁচটা চাহিদা পূরণের মতো, পূরণ করি প্রকৃতির ক্ষতকে। অল্প জায়গা কিংবা ছাদে পরিকল্পিত ভাবে গড়ে তুলি ছোট্ট বাগান। ফুল ফুটুক, পাখিরা আসুক। সেই কলতান ঘুম ভাঙ্গাক সকাল বিকেল আমার তোমার। ঘুম ভাঙ্গাক যান্ত্রিক সভ্যতার।