কাওসার আলম ব্যাপারী
“এবার পঙ্গপাল এসে বড়ো ক্ষতি করেছে” (সহজ পাঠ-দ্বিতীয় ভাগ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) । হ্যাঁ এবার ক্ষতি করছে । বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্ষতি করে এবার ভারতে ঢুকে পড়েছে।এ পর্যন্ত পঙ্গপালের আক্রমণের শিকার রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশ। এমনিতেই সারা বিশ্ব কোভিড-১৯ সংক্রমণের জেরে চরম আর্থিক মন্দা গ্রাস করতে চলেছে সেই সঙ্গে চরম দুর্ভিক্ষের ভ্রুকুটি শুরু হয়ে গেছে। তারমধ্যে গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত পঙ্গপালের আক্রমণ। এই পঙ্গপালের আক্রমণ ভয়াবহ কারনঃ এদের এক একটি দল এক বর্গ কিলোমিটার জুড়ে অবস্থান করে যেখানে ৪(চার) কোটির মত পঙ্গপাল থাকে। এই বিরাট আকারের পঙ্গপালের দলের আক্রমনের লক্ষ্য বস্তু ধান,গম,যব, জোয়ার,ভুট্টা,আখ,তুলো, কলা,কড়াই, ডাল,শাক-সব্জী,পাতা প্রভৃতি! কারণ এগুলো এদের প্রিয় খাদ্য। এরা দেশের পর দেশ পাড়ি দিতে পারে অনায়াসে। এমনকি এরা সমুদ্র পেরিয়ে অন্য দেশে ঢুকতে পারে বহাল তবিয়তে। এক একটি পঙ্গপালের দল টানা মাইলের পর মাইল ও শত শত ফুট উচ্চতা পর্যন্ত উড়তে পারে। ১৯৫৪ তে উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকা থেকে এরকম একটা পঙ্গপালের দল আটলান্টিক সাগর পেরিয়ে গ্রেট ব্রিটেনে পাড়ি দিয়েছিল। ১৯৮৮ তে আরেকটা দল মাত্র ১০ দিনে পশ্চিম আফ্রিকা থেকে আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর দিয়ে ৩১০০ মাইল পাড়ি দিয়ে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছেছিল!
এদের আক্রমণ যেখানে হয় সেই এলাকার শত শত একর জমির ফসল নষ্ট করে দেয়। পঙ্গপালের একদিনের আক্রমণে ৩৫ হাজার মানুষের খাদ্য নষ্ট হয়ে যায়। এদের আক্রমণ এভাবে চলতে থাকে দিনের পর দিন। একটি অঞ্চলের খাদ্যশস্য সাবার করে এরা অন্য অঞ্চলের দিকে এগিয়ে যায়।ইতিমধ্যে হর্ন অফ আফ্রিকার সোমালিয়া, কেনিয়া, উগান্ডা, ইথিওপিয়াকে লণ্ডভণ্ড করে, মধ্যপ্রাচ্যের ইয়েমেন, সৌদি, ইরান হয়ে পাকিস্তান পেরিয়ে পশ্চিম ভারতে কয়েকমাস আগেই ঢুকে পড়েছে। আরেকটা পঙ্গপালের দল পূর্ব আফ্রিকা থেকে আরব সাগর পাড়ি দিয়ে সোজা দক্ষিণ ভারতে ঢুকতে চলেছে। যেকোনো দিন আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে যেতে পারে পঙ্গপালের দল। আশ্চর্যজনক যে এদের সংখ্যাটা এতই বেশি যে এদের উপর হেলিকপ্টার দিয়ে কীটনাশক ছড়িয়েও আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়না। এর আগে যে দেশগুলোতে পঙ্গপালের আক্রমণ ঘটেছে সেই দেশগুলোর সরকার সম্ভাব্য যত ধরনের প্রচেষ্টা করেছিল পঙ্গপালের আক্রমণ ঠেকানোর জন্য প্রায় প্রত্যেকটি প্রচেষ্টা বিফল হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের এখনই এমন কোনো চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন যাতে করে পঙ্গপালের আক্রমনের ক্ষতির পরিমাণ যথা সম্ভব কমানো যায়।
এমনিতেই এই ভারত বর্ষ চরম আর্থিক মন্দার দ্বারপ্রান্তে। তার উপর যদি খাদ্যশস্যের চরম সংকট দেখা যায় তাহলে ভারতবর্ষে হাহাকার অবস্থা শুরু হবে। রাস্তায় – ঘাটে হাজার হাজার মানুষ অনাহারে মারা যাবে। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের মত অবস্থা শুরু হতে পারে। ২০০৩-০৫ সালে উত্তর আফ্রিকায় বড় দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল পঙ্গপালের আক্রমণে। গবেষকরা বলছেন ২০১৯-২০ সালের পঙ্গপালের আক্রমনের প্রভাব উত্তর আফ্রিকার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষকেও হার মানাবে। ইউনাইটেড নেশন্স চরম খাদ্যসংকট ঘটার ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছে। ইতিমধ্যে সোমালিয়া, পাকিস্তানে জাতীয় বিপর্যয় ঘোষণা হয়েছে।আমাদের দেশেও জাতীয় বিপর্যয় হিসেবে ঘনিয়ে আসছে পঙ্গপালের ভয়াবহ আক্রমণ।
পঙ্গপালের আক্রমণের বর্ননা রয়েছে মুসলিমদের ধর্ম গ্রন্থ আল কুরআনে।“অতঃপর আমি তাদের উপরে বন্যা, পঙ্গপাল, উকুন, ব্যাঙ এবং রক্ত প্রেরণ করেছি স্বতন্ত্র নিদর্শন হিসাবে, তবে তারা (ফেরাউন ও মিসরবাসী) অহংকার করেছিল এবং অপরাধী সম্প্রদায় ছিল।” (কোরআন ৭:১৩৩)। এছাড়াও বর্ণিত হয়েছে বাইবেলে ও হোমারের ইলিয়াডে। পঙ্গপালের আক্রমনের ইতিহাস খুবই পুরনো। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণে যখন কোন জাতির মধ্যে পাপাচার খুব বৃদ্ধি পায় তখনই সৃষ্টিকর্তার তরফে মানুষকে ন্যায়ের দিকে ফেরানোর জন্য এবং কিছু মানুষের উপর গজব হিসাবে আপতিত হয়।এ নিয়ে মতান্তর রয়েছে ও থাকবে। এই বিতর্কের মাঝে না গিয়ে আমাদের কে ভয়াবহ বিপদ থেকে বাঁচতে তৎপর হতে হবে। এ সময় শুধু সরকারের উপর নির্ভর করে বসে থাকলে চলবে না। যথাসম্ভব নিজস্ব বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে পঙ্গপালের আক্রমণ থেকে নিজেদের খাদ্যশস্য গুলোকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে হবে। কবি রবীন্দ্রনাথের লেখায় পঙ্গপালের আক্রমন এর কথা আমরা জানতে পারি। তখন এখনকার মতো উন্নত পরিকাঠামো না থাকার পরেও তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমাদেরকেও আসন্ন এই সংকটের মোকাবেলা করতে হবে। ওরা যদি সেইদিন পেরেছিল, আমরা পারব না কেন? এখন থেকেই খাদ্যের অপচয় রোধ করতে হবে ,প্রত্যেক নাগরিককে হিসেবি হয়ে উঠতে হবে, তাহলেই চরম খাদ্য সংকটের ধাক্কা কিছুটা হলেও সামলানোর সম্ভবপর হবে।