ঈশ্বর
মহিবুল আলম
।। সতেরো ।।
তৃতীয় পুরুষ বিসমিল্লাহ খাঁর সানাই শুনছেন। কান্নার মতো সানাই বাজছে আর তৃতীয় পুরুষ চোখ বুজে মাথা হেলিয়ে-দুলিয়ে শুনছেন।
তৃতীয় পুরুষের এহেন দৃশ্য দেখে নারী অবাক না হয়ে পারল না। সে বেশ কিছুক্ষণ হয় এখানে এসে বসে আছে, অথচ এখন পর্যন্ত ওদের মধ্যে তেমন কোনো কথাবার্তা হয়নি। এদিকে সকাল গড়িয়ে প্রায় দুপুর হয় হয় ভাব।
জ্যৈষ্ঠমাসের ভ্যাপসা গরমটা আজ বেশ পড়েছে। নারীর নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। যদিও বাসার ভেতর সিলিং ফ্যানটা ঘুরছে। বারান্দায়ও সিলিং ফ্যানের বাতাস আসছে। বারান্দাটা যেহেতু উত্তরে, তাই দক্ষিণের বাতাস আসছে না। তবে বাসাটার উত্তরে খানিকটা দূর পর্যন্ত কোনো উঁচু দালান নেই বলে বেশ খোলামেলা আকাশটা দেখা যায়।
নারীর কপাল খানিকটা ভিজে গেছে। ব্লাউজ ও ব্রা চুপচুপা ভেজা না হলেও আর কিছুক্ষণ বসে থাকলে এগুলোও ঘামে ভিজে উঠবে। সে বারবার তৃতীয় পুরুষের দিকে তাকাচ্ছে। সে বিরক্ত হচ্ছে। কিন্তু কিছু বলতে পারছে না। এমনিতে ওদের মধ্যে সম্পর্কের দূরত্ব না থাকলেও বয়সের একটা বিরাট ব্যবধানের কারণে তার মধ্যে এখনো একটা জড়তা রয়ে গেছে। সবসময় সবকিছু হুকুমজারি করে বলতে পারে না। অভিমত শোনার জন্য অপেক্ষা করতে হয়।
এ মুহূর্তেও সে অপেক্ষায় বসে আছে। বসে বসে সে তৃতীয় পুরুষের সানাই শোনা দেখছে। তৃতীয় পুরুষ চোখ বুজে সানাই শুনছেন।
তৃতীয় পুরুষ দক্ষিণ খান গলির এই বিল্ডিংটা করার আগে নারীদের গলিতেই একটা ভাড়া বাসায় থাকতেন। গলির শেষ মাথার তিনতলা দালানের দোতলায় ভাড়া থাকতেন। তখন তিনি সবে আমেরিকা থেকে ফিরে এসে অভিনয় জগতে স্থিতি হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। নারীর সঙ্গে তৃতীয় পুরুষের দেখা সেই মুদি দোকানটাতেই। পরপর কয়েকবার দেখা হওয়ার পর নারী নিজেই একদিন যেচে কথা বলে।
তৃতীয় পুরুষ একসময় বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের ডাকসাইটে নায়ক ছিলেন। আশির দশকে রাজাবাদশা বা রাজপুত্রদের নিয়ে যেসব রূপকথার সিনেমা হতো, পরিচালকরা তাকে বাদ দিয়ে সেসব সিনেমা কল্পনাও করতে পারত না। রঙিন বর্ডার দেওয়া চকমকি শার্টপ্যান্ট, লাল টকটকে রঙিন বুটজুতা, মুখে সরু গোঁফ ও ইয়া বড় একটা ভুড়ি…। টিনের তলোয়ার নিয়ে একটা রুগ্ন ঘোড়ায় চড়ে তিনি রাজপুত্র সেজে বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়াতেন। দেখা যেত, নায়িকা বনের ধারে বান্ধবীদের নিয়ে গান গাচ্ছে, হঠাৎ সেখানে ভিলেনের আবির্ভাব। বান্ধবীরা তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে বিনা কারণে উধাও। রাজপুত্রের অভিনয় করা সেই নায়কের ঘোড়ায় চড়ে সেখানে আগমন। একাই আট-দশজন সাঙ্গপাঙ্গ পরিবেষ্টিত ভিলেনকে কুপোকাত- ইঁয়াহু, ঢিসুম-ঢিসুম-ঢিসুম। আবার এমন হতো, বাবা সিংহাসন হারিয়েছে। তিনি রাজমহল থেকে শিশুবয়সে বিতাড়িত হয়েছেন। বড় হয়ে তিনি একাই সেই রাজমহলে গিয়ে সব সৈন্যকে মেরে রাজমুকুট নিয়ে সিংহাসনে বসতেন। নায়িকা নর্তকী হয়ে গান ধরত, “…আঠারো বয়সে আমার, আহা…। তোমার ছোঁয়াতে আমার, আহা…। রঙিন বাগানে ফুল ফুটেছে, আহা…। ফুলে ফুলে ভোমর বসেছে, আহা…। যৌবনের রঙ ধরেছে, আহা…। হৃদয় কেঁপেছে আমার, আহা…। প্রেম হয়েছে আমার, আহা…।”
নারী বয়সে যখন ছোট, তখন গ্রামগঞ্জে তেমন স্যাটেলাইট টেলিভিশন যায়নি। ওদের বিনোদনের একমাত্র অবলম্বন ছিল কোম্পানীগঞ্জের লাকি সিনেমা হল। সে স্কুলে পড়াকালীন চুপিচুপি বান্ধবীদের নিয়ে কিংবা খালাত ভাইবোনদের নিয়ে সেসব সিনেমা দেখতে যেত। সে এক উত্তেজনা ছিল। সিনেমার জগতটা তখন রঙিন মনে হতো। যদিও আজকাল স্যাটেলাইট টেলিভিশনে ওসব সিনেমা দেখলে তার হাসি পায়।
তৃতীয় পুরুষ অবশ্য আজকাল ওসব রূপকথার বা রাজাবাদশার সিনেমা করেন না। আশির দশকে ওসব সিনেমার চাহিদা থাকলেও নব্বই দশকের শুরুতেই এর পড়তি শুরু হয়। এখন বাংলাদেশ চলচ্চিত্রে এসব সিনেমা দর্শকরা কল্পনাও করতে পারে না।
নব্বই দশকে ওসব রূপকথা বা রাজাবাদশাদের কাল্পনিক সিনেমার পড়তির সঙ্গে সঙ্গে তৃতীয় পুরুষের পড়তি শুধু হয়। শুধু ক্যারিয়ারেই নয়, তার পারিবারিক জীবনেও ধস নেমে আসে। নব্বই দশকের শেষের দিকে পেট চালানো দায় দেখে তিনি আমেরিকা পাড়ি জমান। ওখানে গিয়ে তিনি নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। তিনি ছিলেন বাংলা সিনেমার নায়ক। অথচ ওখানকার কোনো বাঙালি তাকে পাত্তা দিতে চায় না। কোথায় পত্রিকার বিনোদনের পাতার তার বড় বড় ছবি থাকত, কোথায় বিনোদন ম্যাগাজিনে তার ব্যাপক-বিস্তৃত সাক্ষাৎকার ছাপা হতো…! একটা সময় তার সিনেমা দেখার জন্য মানুষজন টিকিটের জন্য মারামারি পর্যন্ত করত। তাকে একনজর দেখার জন্য এফডিসি-র গেইটে কৌতূহলীরা দীর্ঘ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকত।
আমেরিকায় গিয়ে তৃতীয় পুরুষ পুরো দশটা বছর রেস্টুরেন্টে ডিশওয়াশিং করে, পেট্রোল পাম্পে সার্ভিস ম্যানের কাজ করে ও নিউইয়র্ক শহরে ট্যাক্সিক্যাব চালিয়ে সাতবছর আগে আবার দেশে ফিরে আসেন। অবশ্য তার ফিরে আসা ছাড়া উপায়ও ছিল না। ভিসার মেয়াদ বহু আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল বলে আমেরিকার ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে ধরে ডিপোর্ট করেছিল।
তবে তৃতীয় পুরুষ বাংলাদেশে ফিরে এলেও একেবারে খালি হাতে ফিরেননি। দশবছর আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে কঠোর পরিশ্রম করে বড় অঙ্কের টাকাপয়সাই জমিয়েছিলেন। এরই মধ্যে দেশে ফিরে তিনি সারুলিয়ার দক্ষিণ খান গলির এই প্লটটা রাখেন। এই চারতলা দালানটা তিনি নিজের জমানো টাকাপয়সা দিয়েই করেন। ব্যাংক থেকে একপয়সাও ঋণ নেননি।
একসময় সিনেমায় রূপকথার রাজপুত্র বা রাজাবাদশার অভিনয় করলেও আজকাল তিনি বিভিন্ন প্যাকেজ নাটকে নায়কের বাবা-চাচার অভিনয় করেন। এতে টাকাপয়সা মন্দ পাচ্ছেন না। এছাড়া বাসাভাড়া পাচ্ছেন বেশ। একটা নিশান সানি মডেলের সাদা গাড়ি হাঁকিয়ে নির্ঝঞ্জাট জীবনযাপন করছেন।
বিসমিল্লাহ খাঁর একটা সানাই শেষ হয়ে আরেকটা সানাই বাজছে। দোতলার ব্যালকনির পরিবেশটা ক্রমশ করুণ থকে করুণতর হচ্ছে। তৃতীয় পুরুষ অনবরত মাথা নেড়েই যাচ্ছেন। এদিকে নারী বারবার বিরক্ত হয়েও কিছু বলতে পারছে না। তৃতীয় পুরুষ তো এরকমই। যখন খুশি মনে থাকেন, তখন তিনি তার শরীর ও মন আনন্দে ভরিয়ে দেন। শতবার ‘আই লাভ ইউ’ বাক্যটাই বলেন। আবার তিনি যখন আপন মনে থাকেন, তখন তিনি তাকে না ছেড়ে দেন, না ধরে রাখেন। তবে তিনি কখনই রূঢ় আচরণ করেন না। বড় জোর গম্ভীর হয়ে থাকেন।
নারী জানে, সৃষ্টিশীল পুরুষরা এমনই হয়। ওরা ভাবের ওপর চলে। এছাড়া একজন মানুষের বয়স ষাটের কাছাকাছি হলে ভাব-গাম্ভীর্য এমনিতেই বেশি থাকে।
তৃতীয় পুরুষ চোখ বুজে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে সানাই শুনতে শুনতে অনেকক্ষণ পর এবার চোখ খুললেন। তিনি সরাসরি নারীর দিকে তাকালেন। একটু মৃদু হাসলেনও।
নারীও মৃদু হাসল। সে স্তব্ধতা কাটিয়ে কিছু বলতে যাবে, এর আগেই তৃতীয় পুরুষ আবার চোখ বুজলেন।
নারী বিরক্ত হয়ে মনে মনে বলল, ধ্যাৎ! সে দৃষ্টি সরিয়ে আশেপাশের পরিবেশটা আবার দেখল। খোলা ইলেকট্রিক তারে একটা বাদুড় মরে ঝুলে আছে। একটা কাক খানিকটা দূরে জানালার কার্নিশে বসে অনবরত ডাকছে- কা কা, কঁ কঁ, কা কা। কাকটা কালো-সাদার মিশ্রণে পাতি কাক। আরেকটা জানালার কার্নিশে দুটো শালিক বসে আছে। সে শুনেছে, দুই শালিক দেখলে নাকি বাড়িতে অতিথি আসে।
নারী শালিক দুটোর দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজে নিজে মৃদু হাসল। সে ভাবল, নিজেই সে অন্যের বাসায় অতিথি হয়ে বসে আছে। এখানে আবার তার অন্য অতিথি কে আসবে? এদিকে দুপুর হয়ে এসেছে। তার খানিকটা ক্ষুধাও লেগেছে। তৃতীয় পুরুষের বাসায় এমনটা হবে জানলে সে বাসা থেকে ঠিকমতো খেয়ে আসত।
নারী একবার ভাবল, একটা বাহানা ধরে সে উঠে চলে যাবে কি না? এমনটা সে আগে দু-একবার করেছে। তৃতীয় পুরুষের ভাবের ভীমরতি ধরলে সে কোনো একটা বাহানা ধরে উঠে চলে গেছে।
কিন্তু পরক্ষণেই নারী ভাবল, নাহ, দুই-তিনদিন পরেই সে ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছে। মাঝখানে বেশ কিছুদিন ওদের দেখা হবে না।
অবশ্য তৃতীয় পুরুষ সচরাচর এমনটা করেন না। বছরে একবার-দুইবার হঠাৎ হঠাৎ এমনটা করেন। তখন নারী বুঝে যায়। তবে বরাবর সে বাসায় এলে তিনি তাকে নিয়ে প্রথমে শরীরের চাহিদা মিটান। তারপর তাকে গাড়ি করে নিয়ে বের হন। দামি দামি বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে নিয়ে দুপুরের খাবার খাওয়ান। কখনো আবার আগে থেকে ওসব খাবার বাসায় এনে রাখেন।
বিসমিল্লাহ খাঁর সানাই হঠাৎ করে থেমে গেল। সিডি শেষ। কিন্তু তৃতীয় পুরুষের তখনো চোখ বোজা। নারী বুঝতে পারল না, তিনি কি সানাই শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছেন?
জানালার কার্নিশে বসা পাতিকাকটা তখনো ডেকে চলছে। ইলেকট্রিক তারে ঝুলে থাকা বাদুড়টা মৃদুমন্দ বাতাসে দুলছে। বাদুরটা এখনো এমন তরতাজা যে, মনে হচ্ছে গতরাতে ইলেকট্রিক তারে আটকে পিষ্ট হয়ে মরেছে। পা দুটো তারে আটকানো। মুখটা নিচের দিকে। ডানা দুটো প্রসারিত করে মেলে দেওয়া।
নারী হঠাৎ পাখির খুব সুন্দর একটা ডাক শুনল- টুইট-টুইট, টুইট-টুইট। ডাকটা যে টুনটুনির ডাক সে তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারল। ছোটবেলা থেকেই সে এই ডাকের সঙ্গে পরিচিত। তার বাবা এই পাখির নাম দিয়েছিলেন, টুনা পাখি। কিন্তু এই ঢাকা শহরে টুনটুনি পাখির ডাক? সে এদিক-ওদিক টুনটুনি খোঁজার চেষ্টা করল। কিন্তু কোথাও খুঁজে পেল না। টুনটুনির ডাকটা আবার এল- টুইট-টুইট, টুইট-টুইট।
তৃতীয় পুরুষ চোখ খুললেন। নারীর দিকে তাকিয়ে নিজে নিজেই বললেন, দরজায় আবার কে কলিংবেল বাজাচ্ছে? বলেই তিনি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। শরীরের আড়মোড়া ভেঙে রুম পেরিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালেন।
নারী তার বোকামির জন্য হাসল। এ বাসার কলিংবেলের শব্দটা সে জানে। তারপরও সে কীভাবে জ্যান্ত টুনটুনি পাখির কথা ভাবল? এই ঢাকা শহরে টুনটুনি পাখি? তাও আবার সারুলিয়ার দক্ষিণ খান গলিতে?