ওহিদ রেহমান
‘শিক্ষা আনে চেতনা, চেতনা আনে বিপ্লব, বিপ্লব আনে মুক্তি’- শব্দবন্ধটি এক্ষেত্রে, এই চিরায়িত ধারা অনুসৃত করেনি। এখানে চেতনা এসেছে জোতদার, জমিদার, মহাজন সর্বপরি বিদেশি ইংরেজ শাসনের শোষণ, বঞ্চনা থেকে। সিধু মুর্মু, কানু মুর্মু, চাঁদ মুর্মু, ভৈরব মুর্মু সঙ্গে তাদের দুইবোন ফুলমনি মুর্মু এবং ঝানু মুর্মুর প্রতক্ষ্য আহ্বানে সাড়া দিয়ে, ১৬৫ বছর পূর্বে ভাগলপুরের ভাগনাডিহি গ্রামে আক্ষরিক অর্থেই সূচিত হয়েছিল দেশের প্রথম গণসংগ্রামের। আশেপাশের ৪০০ গ্রামের ১০,০০০ মানুষ প্রতক্ষ্যভাবে এই আন্দোলনে একাত্ম হয়েছিলেন। এই আন্দোলনের শরিক ছিলেন সমাজের সর্বস্তরের বঞ্চিত জনগোষ্ঠী। মূলত কামার, কুমোর,কুলু, চামার, ডোম সঙ্গে মুসলিম সমাজের একটি অংশ এই আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। একটি পরিবারের আদর্শিক প্রতিবাদের সমগ্রিক সমবেত প্রতিরোধের এক উজ্জ্বলতম নমুনা ১৮৫৫ সালের ৩০শে জুন সংগঠিত হওয়া ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’ বা ‘হুল দিবস’।
এই আন্দোলনের পটভূমি গড়ে ওঠে দীর্ঘ ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে। একটা সময়, আদিবাসীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, রাজমহল পেরিয়ে ভাগলপুর জুড়ে একটি বিস্তৃত জনপদ গড়ে ওঠে। সমগ্র এলাকাটি দেড় হাজার বর্গমাইল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পুরো অঞ্চলটি চিহ্নিত ছিল ‘দামিন-ই-কোহ’ বা পাহাড়ের প্রান্তদেশ নামে। আদিবাসীরা কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে এলাকায় চাষ-আবাদ শুরু করে। এমতাবস্থায়, এলাকাটির উপর নজর পড়ে বিদেশি শাসক ইংরেজ এবং তাদের সাঙ্গোপাঙ্গোদের। তারা উৎপাদিত ফসলের উপর কর আরোপ করে। এবং নিরন্তর এই আগ্রাসন বাড়াতে থাকে। অনেকের জমি বিভিন্ন অজুহাতে কেড়ে নেওয়া হয়। আদিবাসী জনবিন্যাসকে কৌশলে খতম করার নীল নকশা আঁকতে থাকে উঠতি মহাজনরা। বাধ্য হয়ে অনেক আদিবাসী এলাকা ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হন। ফলে বাকিদের মনে বিদ্রোহের আগুন ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকে। সেই প্রেক্ষিতেই ১৮৫৫ সালের ৩০শে জুনের সেই ঐতিহাসিক সভা। যেখান থেকে সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈরব ঘোষনা দেন সারা বিশ্বে চর্চিত এই আন্দোলনের। তাদের মূল বক্তব্য ছিল, অত্যাচারী শোষকদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সবাইকে এক হয়ে লড়তে হবে। এখন থেকে কেউ জমির কোনো খাজনা দেবে না এবং সকলেই যত খুশি জমি স্বাধীনভাবে চাষাবাদ করবে। সাঁওতালদের সব ঋণ এখন বাতিল হবে। এবং আগামীতে তাঁরা মুলুক দখল করে নিজেদের সরকার কায়েম করবে।
১৮৫৫ সালের জুন থেকে চলা এই মুক্তিসংগ্রাম ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হয়। সিধু কানুর নেতৃত্বে ১০ হাজার আদিবাসীর কাফেলা কলকাতা অভিমুখে পদযাত্রা শুরু করলে, প্রশাসন প্রমোদ গুনে। জঙ্গীপুরের তৎকালীন দারোগাবাবু মহেশলাল দত্ত পদযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের অনেকেই আটক করেন এবং আন্দোলনের পুরোধা সিধু কানুদের গ্রেপ্তারে উদ্যত হন। ক্ষোভে ফেটে পড়ে সমবেত আদিবাসীরা। জুলাইয়ের ৭ তারিখ মহেশলাল দত্ত সহ বিদ্রোহীরা ১৯ জনকে হত্যা করেন পাঁচকাঠিয়া নামক স্থানে। ১৭ই আগষ্ট ইংরেজ সরকার তাদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানালে সিধু কানুরা সেটা প্রত্যাখ্যান করে। পরবর্তী পর্যায়ে শাসকের চূড়ান্ত অত্যাচারের বলি হন আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী আদিবাসীরা। অসম এই লড়াইয়ে, ইংরেজদের ছিল আধুনিক সমরাস্ত্র, অন্যদিকে আদিবাসীরা ময়দানে নামে তাদের তীর, ধনুক, বর্শার মতো দেশীয় অস্ত্র সহকারে। একাধিক রেজিমেন্ট ব্যবহার করে, ইংরেজ সরকার প্রায় সকল বিদ্রোহীকে হত্যা করে। নভেম্বর মাসে জারি করা হয় সামরিক শাসন। সিধু মুর্মুকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। ১৮৫৬ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি ফাঁসি দেওয়া হয় কানুকে। তাদের বোনদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। সমগ্র আন্দোলনে প্রায় ৩০ হাজার আদিবাসী শহীদ হয়েছিলেন।
সাঁওতাল বিদ্রোহ আসলে মাথা উঁচু করে বাঁচার লড়াইয়ের অন্য নাম। এই আন্দোলনের শেষ অঙ্ক আন্দোলনকারীদের অজানা ছিল না। খাতা কলমে আদিবাসীরা চূড়ান্তরূপে পরাজিত হলেও, এই আন্দোলনের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। পরবর্তী পর্যায়ে, এই আন্দোলনের সম্মানার্থে গঠন হয় সাঁওতাল পরগণা। অ্যাসলি ইডেন ছিলেন সেই পরগণার প্রথম ডেপুটি কমিশনার। তিনি একাধিক বিষয়ে সদর্থক সিধান্ত গ্রহণ করেন আদিবাসীদের কল্যানে। গঠন করা হয় অভিযোগ গ্রহন কেন্দ্র। স্হানীয় প্রশাসনিক ব্যবস্হায় নিয়োগ দেওয়া হয় ‘মাঝি’ বা মোড়লদের। আদিবাসী সম্প্রদায়ের বিবাদের ক্ষেত্রে নিজস্ব আইন ব্যবহারের সুযোগ প্রদান করা হয়। ১৮৮৫ সালে আসে ‘বেঙ্গল টেনান্সি অ্যাক্ট’, যার দ্বারা আদিবাসীদের সম্পতি সরকারি অনুমতি ছাড়া ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হয়। ফলত, একটা পরিবর্তিত আদিবাসী সমাজ ব্যবস্হার সূচনা হয়, যার স্বপ্ন দেখেছিলেন সিধু, কানু ভৈরব, ফুলমনিরা। ইতিহাসবিদ সুপ্রকাশ রায় তাঁর, ‘ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’ শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন,-“সাঁওতাল বিদ্রোহের মাদল-ধ্বনি যুগে যুগে প্রতিধ্বনিত হইয়া বঙ্গদেশের, বিহার প্রদেশের, সমগ্র ভারতবর্ষের কৃষক-শক্তিকে জাগ্রত করিয়াছে, আত্মপ্রতিষ্ঠার পথ নির্দেশ করিয়াছে।”