শাহনওয়াজ আলী
বল্লাল সেন বাংলার সেন রাজবংশের দ্বিতীয় নৃপতি ছিলেন। তিনি ১১৬০ থেকে ১১৭৯ সাল পর্যন্ত সেনবংশের রাজা ছিলেন। তিনি ছিলেন সেন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বিজয় সেনের পুত্র এবং উত্তরসূরী। রাজা বল্লাল সেন বাংলার সামাজিক সংস্কার, বিশেষ করে কৌলিন্য প্রথা প্রবর্তনকারী হিসাবে পরিচিত। তিনি সুপণ্ডিত ও লেখক ছিলেন। ‘দানসাগর’ ও ‘অদ্ভুদসাগর’ তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা। বল্লাল সেন তাঁর রাজত্বের সময় বহুদূর পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। যেমন :- বরেন্দ্রভূমি, রাঢ়, বঙ্গ, এবং মিথিলা প্রভৃতি এইসব অঞ্চলগুলি তাঁর অধীনস্থ ছিল। সেই সময়ের স্মৃতি আজও বহন করে চলেছে ‘বল্লাল ঢিপি’। এটি অবস্থিত নদীয়া জেলায় বামুনপুকুর বাজারে।
শাহনওয়াজ আলী: বামুনপুকুর বাজারে অর্থাৎ ভক্ত চাঁদকাজীর সমাধিস্থল থেকে পাঁচমিনিট উত্তর-পশ্চিম দিকে হাঁটলেই দেখা যাবে সুপ্রসিদ্ধ বল্লাল ঢিপি। একটু ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, বল্লাল ঢিপির পার্শ্বস্থ একটি গোরস্থান রয়েছে। আর এই ঢিপির নীচে বল্লাল সেনের আমলে নির্মিত প্রাসাদ ছিল বলে অনুমান করা হয়। তবে বর্তমানে এটি পুরাকীর্তি সংরক্ষণ আইন অনুসারে সংরক্ষিত করা হয়েছে। বল্লাল ঢিপি লম্বায় প্রায় চারশো ফুট ও উচ্চতায় পঁচিশ থেকে ত্রিশ ফুট। দূর থেকে দেখলে পাহাড়ের মত দেখায়। ঢিপিটি সবুজ ঘাসে মোড়া, আর চারিদিক ঘেরা রয়েছে কাঁটাতার দিয়ে।
ঢিপিতে ঢোকার সময় বড় লোহার গেটযুক্ত মূল প্রবেশদ্বার রয়েছে। এই মূল প্রবেশদ্বার থেকে দুই পা এগোলে ইঁটের সিড়ি বেয়ে ওঠা যাবে এই ঢিপির উপর। আর উপর থেকে ডানদিকে সিড়ি বেয়ে নামলে দুদিকে প্রায় ত্রিশ ফুট করে উঁচু দেওয়াল দেখা যায়। তবে এই ঢিপির উপরে বেশিরভাগই পোড়ামাটির ইট, চুন ও সুরকি দিয়ে তৈরি হয়েছে। মূল প্রবেশদ্বারে ভিতরে দিকে গেলেই, ঠিক ঢিপির সিঁড়ি ওঠতে ডানদিকে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব একটি বিজ্ঞপ্তিতে নিম্নলিখিত কথাগুলি বর্ণিত রয়েছে দেখা যায় –
“সেন রাজাদের রাজা বল্লাল সেনের নামাঙ্কিত এই বৃহদাকার ঢিপিতে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ ১৯৮২-৮৩ থেকে ১৯৮৮-৮৯ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে উৎখনন পরিচালনা করে। উৎখননের দ্বারা এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে বিস্তৃত প্রাঙ্গনের মধ্যে অবস্থিত বৃহদায়তন ইটের ইমারত যার চারিদিকে ছিল উচ্চ প্রাচীর। উৎখননে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল পঙ্খের মূর্তি, পোড়ামাটির মানুষ, জীবজন্তুর মূর্তি, তামা ও লোহার তৈরি নানান জিনিসপত্র, পেরেক ও নানান প্রত্নসামগ্রী। অষ্টম ও নবম শতকের ধংসপ্রাপ্ত পুরাতন স্থাপত্যকীর্তির উপর পুনঃনির্মিত এই সৌধের উপরিভাগ আনুমানিক দ্বাদশ শতকের। বিভিন্ন সময়ে মেরামত, পরিবর্তন ও সংযোজনের নিদর্শনবাহী এই স্থাপত্য দ্বাদশ শতকে একটি বিশাল দেবালয় রূপ পরিগ্রহন করে।”
বল্লাল সেনের রচিত “অদ্ভুদসাগর” উল্লেখ অনুসারে অনুমান করা হয় যে, বল্লাল ঢিপির প্রাচীনত্ব আটশো বছরের বেশি। আবার অনেকে এটিকে প্রপিতামহ সামন্ত সেনের প্রাসাদের ধংসস্তুপ বলে মনে করেন। তবে পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের মতে বল্লাল ঢিপি সামন্ত সেনের পৌত্র বিজয় সেনের প্রাসাদ।
যাই হোক না কেন, নদীয়ার বামুনপুকুরে এই রাজ প্রাসাদের ধংসস্তূপটি বল্লাল ঢিপি নামেই খ্যাত। এটি পশ্চিমবঙ্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নক্ষেত্র নামে পরিচিত।