তনুময় দেবনাথ: মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ ভুপ বাহাদুর। এই নামটিই যথেষ্ট কোচবিহার বাসীর জন্য। যিনি ছিলেন একজন সুপ্রশাসক, প্রজাহিতৈসী, আধুনিক কোচবিহারের রূপকার।
মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ ভারতের কোচবিহারের রাজতান্ত্রিক রাজ্যের ১৮৬৩ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত মহারাজা ছিলেন।
বয়স যখন মাত্র দশ বছর পিতা নরেন্দ্র নারায়ণ ১৮৬৩ সালে মারা যান। ঠিক একই বছরেই রাজা হিসেবে রাজতন্ত্র পালন করেছিলেন। তিনি শিশু ছিলেন জন্য প্রশাসন ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত করে কমিশনারের কাছে হস্তান্তর করেন। তিনি বেনারসে ওয়ার্ডস ইন্সটিটিউট এ অধ্যয়ন করেন, তারপরে বাঁকিপুর কলেজ, পাটনা এবং শেষপর্যন্ত কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে, আইন নিয়ে অধ্যয়ন করেন। ১৮৭৮ সালে তিনি কলকাতার কেশবচন্দ্র সেনের কন্যা সুনিতী দেবীকে বিয়ে করেন। বিয়ের পরেই তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে চলে যান।

তিনি চার পুত্র ও তিন কন্যার পিতা ছিলেন নামগুলি হল- রাজেন্দ্র নারায়ণ, জিতেন্দ্র নারায়ণ, ভিক্টর নৃত্যেন্দ্র নারায়ণ, হিতেন্দ্র নারায়ণ এবং কন্যা প্রতিভা দেবী, সুধীরা দেবী এবং সুকৃতি দেবী। পরবর্তীতে তার পুত্র রাজেন্দ্র নারায়ণ ও জিতেন্দ্র নারায়ণ পরে কুচবিহারের মহারাজা হন। গায়ত্রী দেবী ও ইলা দেবী তার পুত্র জিতেন্দ্র নারায়ণের মেয়ে।

তিনি ১৮৮৪ সালে একটি আইন প্রবর্তন করেন তার রাজ্যে ক্রীতদাস প্রথা নিষিদ্ধ করেছিলেন। ১৮৮৮ সালে তিনি তার নিজের রাজ্যে উচ্চতর শিক্ষার উন্নয়নের জন্য ভিক্টোরিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন যা বর্তমানে এ.বি.এন.সীল কলেজ নামে পরিচিত। এছাড়াও, তার রানী, সুনিতী দেবীর নামে, একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন যা সুনিতী কলেজ নামে নামকরণ করা হয়। পরবর্তীতে ১৮৮১ সালে সুনিতী একাডেমী নামকরণ হয়। ১৮৮৩ সালে তিনি জলপাইগুড়ি শহরে নৃপেন্দ্র নারায়ণ হল নির্মাণ করেন এবং ১৮৮৭ সালে দার্জিলিংয়ে লেইস জুবিলি স্যানিটিয়ারিয়াম নির্মাণের জন্য জমি প্রদান করেন। তিনি ১৮৮২ সালে কলকাতায় ইন্ডিয়া ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ১৮৮৯ সালে কোচবিহারে দরিদ্রদের জন্য বিনামূল্যে খাবার বিতরণের জন্য আনন্দময়ী ধর্মসালা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ১৮৯২ সালে কোচবিহারে নৃপেন্দ্র নারায়ণ পার্ক বোটানিক্যাল গার্ডেন প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি ১৯০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত কলকাতা ক্লাবের প্রথম সভাপতি ছিলেন।

মহারাজা ছিলেন ক্রিকেটে একজন উদ্যমশীল ব্যক্তি এবং কোচবিহার দলকে উন্নতি করেন এবং সারা পৃথিবীর শীর্ষ মানের খেলোয়াড়দের আমন্ত্রণ জানায়। কোচবিহারের প্রাসাদে তিনি একটি ক্রিকেট মাঠ স্থাপন করেন এবং কলকাতার আলিপুরে একটি মাঠ উন্নতি করেন। তার দল এবং নাটোর মহারাজার দল বাংলায় ক্রিকেটে প্রতিপক্ষ ছিল। ১৮৮৭ – কুইন ভিক্টোরিয়া জয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে তিনি ভারতের সাম্রাজ্যের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আদেশ গ্র্যান্ড কমান্ডার হিসাবে আখ্যা পেয়েছিলেন।
নৃপেন্দ্র নারায়ণ মেমোরিয়াল হাই স্কুল তার নামকরণ করা হয়,যা তার পুত্র মহারাজা জিতেন্দ্র নারায়ণ ১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত করেন।
কোচবিহার রাজবাড়ি হল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোচবিহার শহরের একটি দর্শনীয় স্থান। ১৮৮৭ সালে মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের রাজত্বকালেই লন্ডনের বাকিংহাম প্রাসাদের আদলে এই রাজবাড়িটি তৈরি হয়েছিল।
কোচবিহার রাজবাড়ি ইট দিয়ে তৈরী। এটি ক্ল্যাসিক্যাল ওয়েস্টার্ন শৈলীর দোতলা ভবন। মোট ৫১,৩০৯ বর্গফুট (৪,৭৬৬.৮ মি২) এলাকার উপর ভবনটি অবস্থিত। বাড়িটি ৩৯৫ ফুট (১২০ মি) দীর্ঘ ও ২৯৬ ফুট (৯০ মি) প্রশস্ত। এর উচ্চতা ৪ ফুট ৯ ইঞ্চি (১.৪৫ মি)। ভবনের কেন্দ্রে একটি সুসজ্জিত ১২৪ ফুট (৩৮ মি) উঁচু ও রেনেসাঁ শৈলীতে নির্মিত দরবার হল রয়েছে। এছাড়া বাড়িতে রয়েছে ড্রেসিং রুম, শয়নকক্ষ, বৈঠকখানা, ডাইনিং হল, বিলিয়ার্ড হল, গ্রন্থাগার, তোষাখানা, লেডিজ গ্যালারি ও ভেস্টিবিউল। যদিও এই সব ঘরে রাখা আসবাব ও অন্যান্য সামগ্রী এখন হারিয়ে গিয়েছে।
আজ প্রজা হিতৈষী আর আধুনিক কোচবিহারের কারিগর মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ ভুপ বাহাদুরের ১৫৯ তম জন্মদিন। প্রজাদের ভালোর জন্য তাঁর কাজকর্ম, তাঁর আধুনিক মনন, চিন্তা চেতনা, সাথে সামরিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন বহু বার।
নিউজপিডিয়ার পক্ষ থেকে আধুনিক কোচবিহারের রূপকার মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ ভুপ বাহাদুরের প্রতি রইল আমাদের সশ্রদ্ধ প্রনাম।।