ত্রিদিবেশ বর্মন
গোটা বিশ্বে এই মুহুর্তে সবচেয়ে আলোচিত শব্দবন্ধ “করোনা ভাইরাস”। গত বছরের শেষে এর প্রকোপ চিনে প্রথম শুরু হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতও এর করালগ্রাস থেকে মুক্তি পায়নি। ৬ এপ্রিল দুপুরের মধ্যেই এদেশে মৃতের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়েছে, আক্রান্ত হয়েছেন ৪০০০ এর বেশি মানুষ। তবে আশার কথা এদের মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক মানুষ সুস্থও হয়ে উঠেছেন। ইতিমধ্যে সরকারের তরফে বেশ কিছু পদক্ষেপ করা হয়েছে। কিন্তু চিকিৎসা পরিকাঠামোর উন্নতি এবং প্রান্তিক মানুষের হিতসাধনের জন্য তা যথেষ্ট কিনা সে নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। পাশাপাশি, আমাদের দেশের কিছু দায়িত্বজ্ঞানহীন সহনাগরিকের আচরণ সরকারের পরিকল্পনায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে।
করোনা নিয়ে একটু দেরিতেই যেন কেন্দ্রীয় সরকারের ঘুম ভেঙ্গেছে। এদেশে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার বেশ কয়েকদিন পর ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। প্রথমে শুধু ২২ তারিখ সবাইকে বাড়ি থেকে না বের হওয়ার উপদেশ দিলেন তিনি। এর আসল উদ্দেশ্য ছিল সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। ‘জনতা কার্ফু’ নামে নতুন পরিভাষার সঙ্গে আমাদের পরিচয় হল। সেই সঙ্গে চিকিৎসাক্ষেত্রে যুক্ত ব্যক্তিদের সংহতি ও সম্মান জানাতে ২২ তারিখ বিকেল পাঁচটায় ব্যালকনিতে থালা ও তালি বাজাতে অনুরোধ করলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু গোল বাঁধল সেদিনই। জনতা কার্ফু উপেক্ষা করে মহল্লায় মহল্লায় হুল্লোড় চললো কাঁসর, তাসা, ব্যান্ডপার্টি সহযোগে চললো দেদার ফূর্তি। অতি উৎসাহী কেউ কেউ আবার র্যালি বের করল। কোথাও কোথাও আবার গোমূত্র সেবন সহ নানা অবৈজ্ঞানিক কার্যকলাপে মত্ত হল অনেকে। ফলে কার্ফুর উদ্দেশ্য অনেকাংশে বিফলে গেলো। অবশ্য যে দেশে নিয়ম ভাঙ্গাই স্মার্টনেসের লক্ষণ, সে দেশের আমজনতা সামাজিক দূরত্ব লঙ্ঘন করে বাহাদুরি দেখাবেন এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। সেই সময়ে কংগ্রেস সহ বাকি বিরোধী দলগুলি জানালো করোনার হানাদারি ঠেকাতে তারা সরকারের পাশেই রয়েছে। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার শোচনীয় হাল প্রকাশ্যে এলো। দেশের অনেক জায়গাতেই স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ইকুয়েপমেন্ট পাচ্ছেন না। পিপিই কিট, টেস্ট কিট, পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটর থেকে শুরু করে এন-৯৫ মাস্ক, সবকিছুরই অভাব রয়েছে। সবচেয়ে আশঙ্কাজনক তথ্য হল এদেশে মাত্র ৪০ হাজার ভেন্টিলেটর মজুত রয়েছে। অথচ করোনা মোকাবিলায় ভেন্টিলেটর অন্যতম অস্ত্র বলে চিকিৎসকদের দাবি। পর্যাপ্ত সুরক্ষার দাবিতে স্বাস্থ্যকর্মীরা বিক্ষোভ পর্যন্ত দেখালেন। সরকারের কাছে কিন্তু এর কোনো সদুত্তর ছিল না।
খানিকটা চাপে পড়েই ফের খেল দেখালেন মোদি। এবার বের করলেন অন্য অস্ত্র। তাঁর নতুন নিদান ৫ এপ্রিল ন’টায় নয় মিনিটের জন্য মোমবাতি বা প্রদীপ জ্বলাতে হবে। এর সুফল নিয়ে সরকারের তরফে ব্যাখ্যাও দেওয়া হল। এতে নাকি দেশবাসীর একতা বাড়বে। গোটা বিশ্বকে বোঝানো যাবে করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারতবাসী ঐক্যবদ্ধ। এছাড়া ২৪ মার্চ থেকে শুধু হওয়া ২১ দিনের টানা লকডাউনে দেশবাসীর একঘেয়েমি কাটবে বলেও কোনো কোনো মহল থেকে দাবি করা হল। যথারীতি নেটপাড়ায় এনিয়ে নানা মিম দেখতে পেলাম। ৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশমতো মোমবাতি জ্বললো ঠিকই। সেই সঙ্গে জনতা কার্ফুর দিনের মতোই গণ হিস্টোরিয়া দেখলাম। একদিকে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা হুহু করে বাড়ছে। অপরদিকে এক শ্রেণির উন্মত্ত জনতা দেদার পটকা ফাটাচ্ছে। আকাশপ্রদীপও ওড়ালেন ভক্তগণ। দেশজুড়ে যেনো নেমে এলো অকাল দীপাবলির মেজাজ। একজন তো মুখে আগুন নিয়ে কেরামতি দেখাতে গিয়ে বিপদে পড়লেন। নৈহাটিতে পুড়ল বাগান। উত্তরপ্রদেশের বিজেপি নেত্রী তো “গো করোনা গো” বলে শূন্যে গুলি ছুড়লেন দলবল নিয়ে। মশাল মিছিল সহযোগে “ভারতমাতা কি জয়” স্লোগানও বাদ থাকলো না । সামাজিক দূরত্বের ফের বারোটা বাজলো। এসব দেখেশুনে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের ধারণা, স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর বেহাল দশা ঢাকতে সরকার অসাধারণ ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের পরিচয় দিয়েছে। মিডিয়ার দৃষ্টি সফলভাবে অন্যদিকে ঘোরাতে সক্ষম হয়েছে। যেদেশে স্বাস্থ্যখাতে বাজেট জিডিপির ২ শতাংশও নয়, সেখানে এই আশঙ্কা মোটেও অমূলক নয়। মাঝেরাতে ফুটপাথ বদলের মতোই একটা মাস্টারস্ট্রোকেই হেডলাইন বদল হয়।
আমার কি মনে হয় যে অনেক সময় কিছু করার ক্ষমতা না থাকলে .. মানে কোনো কিছু হাতের নাগালের বাইরে গেলে আমরা অনেক সময় ঠাকুরের নাম নিয়ে মন কে সান্তনা দেই…এক্ষেত্রে ইনি বুঝে গেছেন এনার দ্বারা কিছু হবে না… , তাই এসব মোমবাতি, প্রদীপ, প্রার্থনা এসব করে আমাদের সান্তনা দিতে চাইছেন। আসলে ইনি বুঝেছেন যে ইনি কিছুই করতে পারছেন না । যেসব হল তা আমাদের দেশবাসীর জন্য একদমই স ঠিক হয় নি আমরা সেটা ভালো ভাবেই বুঝতে পারছি। ইনি যদি জাতীয় ঐক্যের জন্য এসব করেছেন তাহলে তো এনার এটা অনেক বড় ভুল সিদ্ধান্ত । আর হেডলাইন বদলের জন্যে যদি করেন তাহলেও বড় ভুল সিদ্ধান্ত।…
পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন। এই মুহুর্তে অবৈজ্ঞানিক ও হুজুগে কার্যকলাপকে প্রশ্রয় দেওয়া অনুচিত।
“হু”-এর পরামর্শমতো গোটা দেশের পাশাপাশি এ রাজ্যেও ঠিকঠাক টেস্ট করা হচ্ছে না।
একেবারেই একমত। এই হেডলাইনের খেলা রাজনীতির একটা ঐতিহ্যবাহী বিনোদন। হেডলাইন বদলানো হোক কিংবা তৈরি করা – এ বিষয়ে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দক্ষতাই প্রায় সমস্ত খেলোয়াড় কে ছাড়িয়ে গেছেন। এ যদি রাজনীতির ক্রিকেট হয়, তবে তিনি বিরাট কোহলি এবং ক্রিস গেইলের অতুলনীয় টু-ইন-ওয়ান কম্বো প্যাক। ক্ষমতা দোষের কিছু নয়। কিন্তু এই ক্ষমতার অতিরিক্ত ব্যবহার প্রবণতা আমাদের করোনা মোকাবেলায় সমস্যা ডেকে আনছে।
জনতা কার্ফু, থালা বাটি বাজানো, ৯ টায় ৯ মিনিটের কথা আলোচিত হয়েছে। একটা ব্যাপার লক্ষ্য করার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মাঝরাতে চমক দিতে পছন্দ করেন। ঠিক নোট বদল এর মতো উনি মাঝরাত্রে চমকে দিয়ে ঘোষণা করবেন এবং পরদিন সকাল থেকে তা লাগু হয়ে যাবে। এতে চমৎকার সুন্দর হেডলাইন হয়। কিন্তু টোটাল লকডাউনের আগে যে ঘর গোছানোর ব্যাপার ছিল এই হেডলাইন তৈরীর প্রবনতায় সেটা মার খেলো। যে সমস্ত লোক দেশে ভুল জায়গায় আটকে পড়েছেন তাদের ব্যবস্থা করার দরকার ছিল। বাড়িতে থাকার জন্য মানুষের কয়েকদিনের প্রস্তুতি নেওয়ার দরকার ছিল। প্রয়োজনীয় ওষুধ পত্রের স্টক দরকার ছিল। সে সব দিকে তাকিয়ে মনে হয় লকডাউন আসছে তা সরকারিভাবে দিন চারেক আগে ঘোষণা করা উচিত ছিল। অর্থাৎ লকডাউন নির্দিষ্ট দিনেই হোক কিন্তু চার দিন আগে ঘোষণা করলে মানুষ হাতে সময় পেতেন। কিন্তু উনি বিখ্যাত ব্র্যান্ড-মোদী সুলভ চমক দিতে গিয়ে মাঝরাতে লকডাউন এর ঘোষণা দিলেন। এবং পরদিন থেকে লকডাউন শুরু। তার ফলে ভারত তাকিয়ে দেখছেন এক রাজ্য থেকে পরিযায়ী শ্রমিকরা যূথবদ্ধভাবে আর এক রাজ্যের উদ্দেশ্যে হাঁটছেন। সমস্ত দিন। সমস্ত রাত।
ঠিকই তো। “কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায় ?” পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা চোখে দেখা যায় না। মাথায় রোদ নিয়ে আবালবৃদ্ধবনিতা যেভাবে হাইওয়ে ধরে হেটে যাচ্ছেন, সত্যিই বেদনার। পরিকল্পনামাফিক লকডাউন করা উচিত ছিল।