মনিরুল ইসলাম রাজী, মালদা
“এরকম ভয়ঙ্কর সময় আমার জীবনে আসেনি….”, কথাগুলো হেসে হেসেই বলছিলেন সেখ মিলন। বাড়ি মালদা জেলার হরিশ্চন্দ্রপুর থানার আঙ্গারমুনি গ্রামে। মাস কয়েক আগে পরিবারসহ পাড়ি দিয়েছিলেন ভিন রাজ্যে। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায়। পাঞ্জাবের জলন্ধরে শুরু করেছিলেন চুলের ব্যবসা। লকডাউনের জন্য ব্যবসা বন্ধ হয়ে যা কিছু আয় করেছিলেন তাও নিঃশেষ হয়েছে। প্রহর গুনছিলেন সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ার। চতুর্থ দফার লকডাউন চিন্তা বাড়িয়ে দেয় মিলনের। বাড়ি ফিরে আসা ছাড়া আর কোন উপায় ছিলনা। কেন্দ্র বা রাজ্য কেউই কোন ব্যবস্থা করেনি। অগত্যা এই লাখ টাকায় ঘরে ফেরার আয়োজন করতে বাধ্য হয় মিলন, হাজিরুল, শাহ আলমরা।
এর থেকেও করুণ কাহিনী সালদহ গ্রামের শাহ আলমের। পাঞ্জাবে ফেরিওয়ালার কাজ করে সে। “আর কিছুদিন ওখানে থাকলে না খেতে পেয়ে মারা যেতাম”, বললেন শাহ আলম। বাড়ির একমাত্র উপার্জনকারী সে। উপার্জন বন্ধ হয়ে তাঁর পরিবারের যে কি করুণ অবস্থা কে জানে?
মালদা জেলার হরিশ্চন্দ্রপুর থানার জনা বত্রিশেক শ্রমিক বাড়ি ফেরার জন্য নিজেরা বাস ভাড়া করতে বাধ্য হয়েছেন। জলন্ধর থেকে হরিশ্চন্দ্রপুরের দূরত্ব প্রায় ১৮০০ কিমি। বাসের ভাড়া দেড় লক্ষ টাকা। ভাড়া বাবদ জন প্রতি লেগেছে পাঁচ হাজার টাকা করে। এই ভাড়ার টাকা জোগাড় করতে হয়েছে ধার করে অথবা ঋণ করে।
“কি করব? বাড়ি তো ফিরতে হবে”, বলছিলেন মিলন। কিন্তু বাড়ি ফিরতে এত ঝামেলা ঝক্কি পোহাতে হবে তাঁরা কল্পনা করতে পারেননি। বাস মালিকের সাথে যোগাযোগ, মেডিক্যাল ক্লিয়ারেন্স, সরকারি পারমিশন- এসব করাতে লেগে যায় ৪-৫ দিন। লকডাউনের মাঝে ভিনরাজ্যে থেকে শ্রমিকদের পক্ষে এত কিছু করা সহজ ব্যাপার নয়। অ্যাডভান্স পাওয়ার পর বাস মালিকেরা অনেক সময় গড়িমসি করে। ঠিক যেমন দিল্লী থেকে বাড়ি ফিরতে চাওয়া মহমুদদের সাথে করেছিল বাস মালিক। অ্যাডভান্স পাওয়ার পর আজ-কাল করতে করতে কাটিয়ে দেয় এক সপ্তাহ।
সব ঠিকঠাক করে সোমবার রাতে রওনা দেয় মিলনরা। প্রায় ৪৮ ঘন্টার যাত্রাপথ। পরিবারের সাথে বাচ্চা নিয়ে এই দীর্ঘ যাত্রাকালে অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। ঠিকমতো খাওয়া আর পানীয়জল মেলেনা রাস্তায়। অনেক জায়গায় স্থানীয়রা বাড়ি ফেরত শ্রমিকদের খাওয়ার ও পানীয়জল সরবরাহ করেছে। এতে অনেকটাই স্বস্তি পায় শ্রমিকরা। এই সমস্ত ত্রাণকর্মীদের ধন্যবাদ জানাতে ভুলেননি তাঁরা। শত কষ্ট সহ্য করতে প্রস্তুত শ্রমিকরা। “শুধু বাড়ি ফিরতে চাই”- এই ছিল তাঁদের ইচ্ছা। “আমরা শ্রমিক বলেই এত কষ্ট করতে হচ্ছে আমাদের”- কিছুটা আক্ষেপের সুরেই কথাগুলো বলছিলেন মিলন।
বৈজনাথপুরের সহেল জানালেন, “ভাড়া ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে ছয় হাজার টাকা লেগেছে প্রায়। এই দুর্দিনে কেউ সোনা বন্ধক দিয়ে, কেউ ফসল বা ছাগল বিক্রি করে, কেউ বা মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে সেই টাকা জোগাড় করেছে।” বাড়ি থেকে সেই টাকা জোগাড় করে পাঠাতে কত যে সমস্যা হয়েছে তা কিছুটা হলেও আঁচ করা সম্ভব।
এদিকে কেন্দ্র সরকার এবং রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে একগুচ্ছ পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা কার্যকর যে হচ্ছেনা তা বুঝতে পারা যাচ্ছে এঁদের অভিজ্ঞতা থেকে। বাড়ি ফেরার জন্য কোন ট্রেনের ব্যবস্থা হলনা সহেলদের জন্য। যেখানে রেল দাবী করছে যে এখন পর্যন্ত ২২ লক্ষ শ্রমিককে তারা বাড়ি ফিরিয়েছে, চালানো হয়েছে ১৬০০’র বেশী স্পেশাল ট্রেন। কিন্তু গত কয়েকদিনে মালদা জেলার হরিশ্চন্দ্রপুর ও চাঁচল থানার কয়েকশো পরিযায়ী শ্রমিককে কেন নিজের উদ্যোগে হাজার হাজার টাকা খরচ করে বাড়ি ফিরতে হয়েছে থেকে যাচ্ছে প্রশ্ন।
জানতে পারা গেল রাজ্য সরকারের “স্নেহের পরশ” প্রকল্পে আবেদন করেছিল সবাই। দু-একজন ছাড়া সিংহভাগ এখনও পর্যন্ত কোন সহায়তা পায়নি। নিজ নিজ এলাকার জনপ্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ করেও লাভ হয়নি কোন। সমস্যার কথা শুনে এড়িয়ে গেছেন তাঁরা। সাড়া দেননি। এমন অভিযোগ করলেন সবাই।
এই প্রতিবেদন যখন লেখা হচ্ছে মিলনদের বাস তখন উত্তরপ্রদেশে। আশা করা যায় বুধবার রাতের মধ্যে তাঁরা ফিরতে পারবেন নিজেদের গ্রামে। এত ক্লান্তির পরে হয়তো তাঁদের ঠাঁই হবে কোন কোয়ারান্টাইন সেন্টারে। প্রাণপ্রিয় জন্মভূমিতে ফিরতে পেরে তাঁরা খুশি তো হবে, কিন্তু সরকারের এই অবহেলা তাঁদের যে কঠোর আত্মনির্ভরতার পাঠ দিয়ে যাবে তা তাঁরা দীর্ঘদিন মনে রাখবেন হয়তো।
লাখ টাকার এই বাড়ি ফেরার গল্প চাপা পড়ে যায় একগুচ্ছ সরকারি পরিকল্পনার তলায়। দেশ জানতেও পারেনা।