কাওসার আলম ব্যাপারী
করোনা আতঙ্ক সারাবিশ্বকে গ্রাস করেছে। চিনে সংক্রমণ শুরু হওয়ার পরে সারাবিশ্বে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে। সংক্রমণ ঠেকাতে বিশ্বের বহু দেশ এখন ‘টোটাল লকডাউন’। দিন যত গড়াচ্ছে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। এই রোগের এখনো এন্টিভাইরাস তৈরি হয় না হওয়ায় যথাযথ চিকিৎসা সম্ভবপর হচ্ছে না। “ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডন এর গাণিতিক বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক নেইল ফার্গুসনের নেতৃত্বেএকদল গবেষক ব্রিটেন, আমেরিকা ও ইতালির করোনা – তথ্য বিশ্লেষণ করে যে পূর্বাভাষ জারি করেছেন, তাতে অভূতপূর্ব বললেও কম বলা হবে। গবেষকদের দাবি, করোনা প্রতিরোধে ব্যবস্থা না নিলে আমেরিকা ও বৃটেনের ২৭ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হতে পারে। এর মধ্যে ২২ লক্ষ মার্কিন নাগরিক। আর সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকার যদি চূড়ান্ত পর্যায়ে বিধিনিষেধ জারি না করে, সেক্ষেত্রে ২.৫ লক্ষ মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। গবেষক দলটি করোনা সংক্রমণের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান এর সঙ্গে ১৯১৮ সালের ইউরোপের ফ্লু সংক্রমনের বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন”। COVID-19 সংক্রমণে বিশ্ব যখন দিশেহারা তখন অন্ধকারে আশার আলো বিশ্বের ইতিহাস। এর আগে বহুবার বিশ্বকে গ্রাস করেছে মহামারী সংক্রমণ।
অন্য একটি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে –
১৭২০ – বুবোনিক প্লেগ
১৭২০ সালে পশ্চিম ইউরোপে মধ্যযুগীয় প্লেগের বড় আকারের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছিল।
এই রোগটির ভাইরাস “গ্র্যান্ড সেন্ট আন্টোইন” নামে একটি মার্চেন্ট জাহাজে পৌঁছেছিল, যখন জাহাজটি মধ্য প্রাচ্যে ভ্রমণ করছিলো সেই সময় সংক্রামিত যাত্রীরা উঠে পড়েছিলে জাহাজে।জাহাজটি ফ্রান্সের মার্সেইতে পৌছানোর পর পুরো শহরে ছড়িয়ে পরে রোগটি। এই রোগটি পরবর্তী দুই বছরে শহরে ৫০,০০০ এবং আশেপাশের প্রদেশ এবং শহরগুলিতে আরও ৫০,০০০ লোককে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিলো।বিপুল সংখ্যক মৃত্যুর পর প্লেগের প্রকোপ থেকে সেরে উঠতে এবং অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ পুনরুদ্ধারে কয়েক বছর সময় লেগেছিল পশ্চিম ইউরোপের।
১৮২০ – কলেরা
১৮২০সালে কলেরা থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইনে ছড়িয়ে পড়েছিল। শুধু জাভা দ্বীপেই এই প্রাদুর্ভাবের ফলে ১০ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল।
১৯২০- স্প্যানিশ ফ্লু
১৯২০ সালে সারাবিশ্ব স্পেনিশ ফ্লু ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীর মুখোমুখি হয়েছিল।যা ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মকতম ছিলো, কয়েক বছরে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলো এই ফ্লু’তে।এটি সেইসময় পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষকে সংক্রামিত করেছিলো এবং প্রায় ৬৫০,০০০ আমেরিকান সহ প্রায় ২০ মিলিয়ন থেকে ৫০ মিলিয়ন মানুষ পরবর্তি কয়েক বছরে এই ফ্লু’তে মৃত্যুবরণ করেছিলো।
এবার ২০২০ – করোনা (COVID- 19)
২৫০ খ্রিস্টাব্দে সাইপ্রিয়ানের প্লেগ মহামারী ‘ব্ল্যাক ডেথ’-এর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর চিত্র দেখা যায় ১৩৪৬ থেকে ১৩৫৩ সালে। ‘ব্লাক ডেথ’-এ আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল অন্তত আট কোটি মানুষ।
রোমে গুটিবসন্ত মহামারী রূপ নিয়েছিল ১৬৫ খ্রিস্টাব্দে। মানুষ পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল কিন্তু মৃত্যু পিছু ছাড়েনি। ৪৩০ খ্রিস্টাব্দে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে গ্রিসে। এক লাখ মানুষ মারা যায় সে সময়। একশ বছর পর ইউরোপ, মিসর ও পশ্চিম এশিয়ায় প্লেগের ছোবল লাগে। গোটা পৃথিবীর ৪০ শতাংশ মানুষ সে সময় মারা গিয়েছিল। সেময়ও মানুষ ঘর ছেড়ে বের হতো না।‘প্লেগ অব শ্যারো’ ছড়িয়ে পড়েছিল বর্তমান ইরানেও।
৭৩৫ থেকে ৭৩৭ সালে গুটিবসন্ত বা স্মল পক্সে জাপান প্রায় জনমানবশূন্য হয়ে যায়। একই শতাব্দীতে বাইজ্যান্টাইন সাম্রাজ্য প্লেগের কারণে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায়।ষোলো শতাব্দীতে নিউ স্পেনে (বর্তমান মেক্সিকো) স্যালমোনেলা জাতীয় ব্যাকটেরিয়ার আক্রমনের কারনে ৮০ শতাংশ মানুষ মারা যায়।
১৫৬৩ সালে লন্ডনে প্লেগে মারা গিয়েছিল বিশ হাজারেরও বেশি মানুষ। ১৬১৬ সালে স্মল পক্স, ইনফ্লুয়েঞ্জা, টাইফাস, অজানা আরও ভাইরাস জ্বরে লন্ডন মৃত্যুর মুখে পড়ে। ঘরে ঘরে মানুষ মরতে শুরু করে। ১৬২৯-১৬৩১ সালে ইতালিতে ছড়িয়ে পড়া প্লেগ রোগে আড়াই লাখ মানুষ মারা যায়। এরপরের শতকে ১৭৩৮ সালে বলকান অঞ্চলে প্লেগে ৫০ হাজার মানুষ মারা যায়।একই শতকে রাশিয়া ও পার্সিয়া ভয়ঙ্কর মহামারীতে দুই লাখ মানুষ মারা যায়।
উনিশ শতকের কলেরায় ইউরোপ ও এশিয়ায় এক লাখ মানুষ মারা যায় । সে সময় কলেরার কোনো প্রতিষেধক ছিলোনা বিশ্বে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি আবার কলেরা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল।সেসময় ইউরোপ, এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকাতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় এক লাখে। তৃতীয়বারে কলেরা মহামারীর রূপ নেয় রাশিয়াতে এবং এক লক্ষাধিক মানুষ মারা যায়। উনবিংশ শতাব্দী শেষের দিকে ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায় এক লাখের বেশি মানুষ। এরপর চীনে প্লেগ কেড়ে নেয় ৫০ হাজার মানুষের জীবন। বিংশ শতাব্দীর এশিয়ান ফ্লুতে পৃথিবীতে প্রায় দুই লাখ মানুষ মারা যায় ।
১৯৬০ সালে এইচআইভি বা এইডসের সঙ্গে পরিচয় ঘটে পৃথিবীবাসীর। এখনও পর্যন্ত প্রত্যহ মানুষ মারা যায় এই রোগে । পোলিওর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে বিশ্বেকে । তবে একবিংশ শতাব্দীতে সার্স, মার্স, ডেঙ্গু, জিকা, ইবোলার মতো প্রাণঘাতী রোগের কথা জেনেছে বিশ্ব। তবে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় মহামারী হচ্ছে করোনাভাইরাসের আক্রমন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা আটকাতে যত বেশি সম্ভব মানুষকে পরীক্ষার আওতায় নিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছে।
এত কিছুর মাঝেও আশার আলো এই যে, করোনা ভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে আসছে। মৃত্যুর হার কমেছে।পরিসংখ্যান বলছে এই ভাইরাসে আক্রান্ত ১০০ জন রোগীর মধ্যে ৩ জন রোগী মারা যায়। মৃতদের মধ্যে বয়স্করা বেশি। আক্রান্তদের মধ্যে সেরে ওঠার পরিমাণই বেশি।
বিশ্ব যেমন এর আগেও বহু মহামারী দেখেছে এবং সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আশা করে যায় এবারেও এর ব্যতিক্রম হবে না। আতঙ্কিত না হয়ে করোনাভাইরাস ঠেকাতে প্রয়োজনীয় নির্দেশিকা মেনে চলুন । বিপদ যেমন আসে, তেমনি সময় মত বিপদ সরে যায়। কবির ভাষায়-“মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে।”