তাহমিদুল ইসলাম
২০০৯ সালে ব্রায়ান অ্যাকটন এবং ইয়ান কুম হোয়াটসঅ্যাপ মেসেঞ্জার নামক একটি তাৎক্ষণিক মেসেজিং অ্যাপ নিয়ে আসে। যা ফোন ভিত্তিক মেসেজিং অ্যাপে বিপ্লব ঘটিয়ে দেয়। যার ফলে হুহু করে বাড়তে থাকে এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা। ফেসবুকের ইতিহাসে সর্বোচ্চ খরচে কিনে নেওয়া হয় এই কোম্পানীকে।
হোয়াটসঅ্যাপ তার ব্যবহারকারীদের কাছে নতুন শর্তাবলী এবং গোপনীয়তার কথা জানিয়ে অ্যাপের মধ্যেই নোটিফিকেশন পাঠিয়েছে এবং সেটার সাথে একমত হতে বলে ওই অপশন এ ক্লিক করতে বলেছে।
আপাতত একমত অপশন এ ক্লিক না করে হোয়াটসঅ্যাপ চালানো গেলেও ফেব্রুয়ারীর ৮ তারিখের পর আর চালানো যাবেনা। হোয়াটসঅ্যাপে থাকতে হলে তাদের এই নিয়ম মানতেই হবে নয়তো আর সেটি চালানো যাবে না।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে তাৎক্ষণিক মেসেজিং অ্যাপ হিসেবে প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা পায় হোয়াটসঅ্যাপ। ২০১৪ সালে ১৯.৩ বিলিয়ন ডলারে ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপকে কিনে নেয়। হোয়াটসঅ্যাপ ফেসবুকের কাছে বিক্রী হওয়ার খবরে সারা বিশ্বজুড়ে মানুষ ক্ষেপে যায়, ফলে প্রচুর মানুষ টেলিগ্রাম এবং লাইন অ্যাপে সুইচ করে।
রাতারাতি টেলিগ্রাম আট মিলিয়ন নতুন গ্রাহক পায় আর লাইন পায় দুই মিলিয়ন নতুন গ্রাহক।
হোয়াটসঅ্যাপের দুই প্রতিষ্ঠাতা ব্রায়ান অ্যাকটন এবং ইয়ান কুম ফেসবুকের শেয়ার পাওয়ার ভিত্তিতে, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকের মালিকানায় চলে আসে। ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ কিনে নেওয়ার পরও হোয়াটসঅ্যাপ স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের মত করে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছিল। কিন্তু ২০১৬ তে প্রথম ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ মেসেঞ্জারের প্রাইভেসী পলিসিতে সামান্য পরিবর্তন আনে। এরপর থেকেই ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপের উপর হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে। ফেসবুক তাদের গ্রাহকদের তথ্য সংগ্রহ এবং ক্ষেত্রবিশেষে বাইরের পার্টির কাছে বিক্রি করে দেওয়ার কেলেঙ্কারি এবং ফেসবুকের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি (যা ক্যাম্ব্রিজ এনালিটিকা নামে পরিচিত) ফাঁস হওয়ার পর হোয়াটসঅ্যাপের প্রতিষ্ঠাতা ব্রায়ান অ্যাকটন হোয়াটসঅ্যাপ ছেড়ে দেন।
তিনি সে সময়ে গ্রাহকদেরকে ফেসবুক ডিলিট করতে বলেন এবং #DeleteFacebook নামের ক্যাম্পেইন করেন।
হোয়াটসঅ্যাপ ছেড়ে চলে আসার পর ব্রায়ান অ্যাকটন সিগন্যাল মেসেঞ্জার (Signal Messenger) প্রতিষ্ঠা করেন।
সিগন্যালের চ্যাটে End to End এনক্রিপ্টেড ফিচার রাখা হয়, যা গ্রাহকদের কোনো তথ্য স্টোর করেনা। টেলিগ্রামের পাশাপাশি, গোপনীয়তা রক্ষাকারী মেসেঞ্জার হিসেবে সিগন্যাল প্রচুর জনপ্রিয়তা লাভ করে।
কী আছে হোয়াটসঅ্যাপের নতুন প্রাইভেসী পলিসিতে?
ফেসবুক নতুন পলিসিতে বলছে, তারা গ্রাহকদের তথ্য সংগ্রহ এবং শেয়ারিংয়ে পরিবর্তন আনছে। যে
পরিবর্তনগুলোর হয়েছে সেগুলো হল, তারা এখন থেকে গ্রাহকদের যে মেটাডেটা কালেক্ট করবে সেগুলো তাদের মূল কোম্পানী ফেসবুক এবং ফেসবুকের অধীনস্থ কোম্পানীগুলো পাবে।
আর মেটাডেটা হচ্ছে আপনি ফোনে কী করছেন, কতক্ষণ ব্রাউজিং করছেন, কী ফোন ব্যবহার করছেন, কতক্ষণ ব্যবহার করছেন, কতক্ষণ নেট কানেকশন অন থাকছে, আপনি কী ব্রাউজ করছেন, আপনি কতক্ষণ সময় ধরে অ্যাপ চালাচ্ছেন, মোট কত মেসেজ করছেন, মোট কত কল করছেন, কার সাথে বেশী চ্যাট করছেন এবং আপনার লোকেশন ডেটা। এমনকি আপনার জিপিএস যদি অফ করাও থাকে, তাও সে এপ্রক্সিমেট লোকেশন নেবে।
এছাড়াও আপনার ফোনে থাকা যাবতীয় কন্ট্যাক্ট নাম্বার, তাদের আইডি, তাদের মেটাডেটা কালেক্ট করবে এবং ফেসবুকের সাথে শেয়ার করবে। ব্যাংক ইনফরমেশন, ট্রানজ্যাকশন এসবও ফেসবুক পাবে। মেটাডেটা এতটাই শক্তিশালী সিস্টেম যে, এর দ্বারা যেকোনো মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
যদিও হোয়াটসঅ্যাপ তাদের চ্যাট ফিচারে ‘End to End’ এনক্রিপশন এখনো চালু রাখবে বলে জানিয়েছে। যার ফলে মেসেজে থাকা তথ্য হোয়াটসঅ্যাপ বা ফেসবুকের কাছে থাকবে না। তবে প্রোফাইলের নাম, নাম্বার, ছবি এসব ফেসবুক পাবে।
কিন্তু ফেসবুকের অতীতে গ্রাহকদের অজান্তে তাদের তথ্য সংগ্রহের ইতিহাস থাকায় গ্রাহকগণ ভয় পাচ্ছেন, ফলে হয়তো হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজের তথ্যও ফেসবুক গ্রাহকদের না জানিয়ে সংগ্রহ করে নিতে পারে।
এছাড়া হোয়াটসঅ্যাপের বিজনেস অ্যকাউন্টের তথ্য বাইরের কোম্পানির সাথে শেয়ার করা হতে পারে বলে জানাচ্ছে তাদের নতুন নিয়ম।
তবে হোয়াটসঅ্যাপের ইউরোপ এবং ইউকের গ্রাহকদের নিয়ম এবং গোপনীয়তা নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। সেগুলো আগের মতই থাকবে। অর্থাৎ হোয়াটসঅ্যাপের ইউরোপীয় গ্রাহকদের কোনো তথ্য তারা ফেসবুকের সাথে শেয়ার করবে না। কিন্তু বাকী দুনিয়ার গ্রাহকদের তথ্য তারা শেয়ার করবে। আপনার সম্পর্কে থাকা যাবতীয় তথ্য যাবে ফেসবুকের কাছে। নতুন পলিসিতে এখনও হোয়াটসঅ্যাপে কোনো বিজ্ঞাপন আসবেনা। তবে ভবিষ্যতে সেটিতে পরিবর্তন আসার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
এই মুহূর্তে সিগন্যাল এবং টেলিগ্রামের জনপ্রিয়তা বেড়ে চলেছে। কারণ টেলিগ্রাম এবং সিগন্যাল তাদের গ্রাহকদের কোনো তথ্য কারও সাথে শেয়ার করেনা এবং নিজেরাও সংগ্রহ করেনা।
সিগন্যালের টুইটার অ্যকাউন্ট থেকে করা #DumpWhatsApp ক্যাম্পেইন ইতিমধ্যে ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে। এই মুহূর্তে টেসলা এবং স্পেসএক্সের সিইও বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি এলন মাস্কও এই ক্যাম্পেইনে যোগ দিয়েছেন৷ তিনি সিগন্যাল ইউজ করতে বলে টুইট করেছেন। ইতিমধ্যে ইন্ডিয়া এবং কলম্বিয়াতে গুগল প্লে স্টোরে সিগন্যাল ডাউনলোডের ক্ষেত্রে এক নাম্বারে চলে এসেছে। টেলিগ্রামও ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে।
অন্যদিকে ফেসবুকের সহপ্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রমোদীর ভালো সম্পর্ক থাকায় অনেকে হোয়াটসঅ্যাপ ছাড়ছেন। মার্ক জুকারবার্গ তাঁর ফেসবুকের ফোর্থ ভিশনের মধ্যে নরেন্দ্র মোদীকে বিশেষভাবে মেনশন করে হাইলাইট করেছিলেন।
যেখানে তিনি মোদীর সাথে ভারতকে এবং প্রযুক্তিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে উভয়ের যৌথ সহযোগিতার কথা বলেছেন।
হোয়াটসঅ্যাপ এর ২০২০ পর্যন্ত গ্রাহক সংখ্যা ছাড়িয়েছে ২০০ কোটি। প্রাইভেসী পলিসির কারণে সহপ্রতিষ্ঠাতা ব্রায়ান অ্যাকটন ছেড়েছেন এই প্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠা করেছেন নতুন এবং নিরাপদ অ্যাপ সিগন্যাল। যেটা বিশ্বব্যাপী সাংবাদিক এবং কর্মীরা ব্যবহার করেন সরকারের নজরদারী এড়াতে। নতুন প্রাইভেসী পলিসির ফলে বেশীরভাগ সচেতন ব্যবহারকারীরা হোয়াটসঅ্যাপের বদলে সিগন্যাল, টেলিগ্রাম এবং লাইনের দিকেই ঝুঁকবেন। এখনো পর্যন্ত এমনটাই দেখা যাচ্ছে।
অনেক তথ্যবহুল লেখা,,,ধন্যবাদ তাহমিদুল ইসলাম(মাইকেল স্কোফিল্ড) ভাইকে, আমাদের সচেতন করার জন্য।।
অনেক তথ্য জানতে পারলাম। তবে সিগনাল নিয়ে খুব কম কথা হলো।