রবিউল হোসেন: আজ থেকে ৩৪ বছর আগে সুইডেনের এক ব্যস্ত রাজপথে রাতের বেলা আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারান দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী উলফ প্যালমে। স্ত্রীকে নিয়ে সিনেমা দেখে বাসায় ফেরার সময় সুইডেনের সবচেয়ে ব্যস্ততম স্টকহোমের রাস্তায় তাকে কে বা কারা পেছন থেকে গুলি করেছিল।
ঘটনার সময় প্যালমের সঙ্গে কোনো নিরাপত্তা রক্ষী ছিল না। ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে দীর্ঘদেহী এক মানুষ হঠাৎই পেছনে এসে খুবই কাছ থেকে দুবার গুলি চালায়। একটা গুলি লাগে প্যালমের পিঠে। অন্য গুলি লাগে লিসবেটের গায়ে। দশ বারোজন মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে দেখছিল এক ব্যক্তি গুলি করে ছুটে পালাচ্ছে। পরে পাশের এক রাস্তার সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠে, তারপর মিলিয়ে যায়।
উলফ প্যালমে মাটিতে পড়ে যাবার আগেই মারা যান। সুইডেনের মানুষ ঘটনার আকস্মিকতায় সেদিন স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। দেশবাসী টিভি খুলে দেখলো প্রকাশ্য রাস্তায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খুনের খবর। সারা দেশ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। সুইডেনে যে এমন ঘটনা ঘটতে পারে মানুষ বিশ্বাসই করতে পারছিল না।
তবে অবাক করা ঘটনা ছিল, সুইডেনের ব্যস্ততম রাস্তায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে খুন করে উধাও হয়ে যাওয়া আততায়ীকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছিল না। পুলিশও সে মুহূর্তে এত হতবাক হয়েছিল যে তারা দ্রুত অপরাধের স্থল ঘিরে ফেলতেও ভুলে গিয়েছিল। আততায়ী পালিয়ে যাবার কয়েক ঘন্টা পরেও শহর কেন্দ্রের সামান্য একটু এলাকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।
ঘটনাটি ছিল সেই ১৯৮৬ সালের। কে খুন করেছিল প্রধানমন্ত্রীকে? এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য হাজার হাজার মানুষকে জেরা করা হয়েছিল। অবশেষে এক ছিঁচকে চোরকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। যদিও পরে সেই রায় নাকচ করে দেয়া হয়। তবে ৩৪ বছর পর সেই প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেয়েছেন সুইডিশ আইনজীবীরা।
অবশেষে তারা জানিয়েছেন, উলফ প্যালমেকে গুলি করে পালিয়ে যাওয়া দীর্ঘদেহী সেই আততায়ীর নাম স্টিগ এংগস্ট্রম। যে লোকটি ‘স্ক্যানডিয়া ম্যান’ নামেও পরিচিত ছিল। তবে বিচার হওয়া কিংবা দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগে ২০০০ সালে সে আত্মহত্যা করে বসে।
এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান কৌঁসুলি ক্রিস্টার পিটারসন বলেন, স্টিগ এংগস্ট্রম যেহেতু বেঁচে নেই, তাই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করতেও পারবো না। তাই এই তদন্তের এখানেই ইতি টানার সিদ্ধান্ত আমরা নিয়েছি। তবে খুনের তদন্তের বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ক্রিস্টার পিটারসন জানিয়েছেন, এই খুনের তদন্তে প্রথমে স্টিগ এংগস্ট্রমকে সন্দেহ করা হয়নি। কিন্তু যখন তার নাম সন্দেহভাজনদের তালিকায় আসে, তখন তারা জানতে পারেন সে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে দক্ষ। কারণ সে সেনাবাহিনীতে ছিল এবং একটি শ্যুটিং ক্লাবের সদস্য ছিল।
খুনের পেছনে কী মোটিভ করেছিল এংগস্ট্রমের? এ প্রশ্নেরও উত্তর পাওয়া গেছে, উলফ প্যালম ছিলেন বামপন্থী। তার সেই নীতির বিরোধী ছিলেন এংগস্ট্রম। তাছাড়া তার নিজের এলাকায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সমালোচক এক গোষ্ঠীর সঙ্গে তার দহরম মহরম যোগাযোগ ছিল।
কেন খুনি হিসেবে শনাক্ত করা যায়নি এংগস্ট্রমকে- এমন প্রশ্নের উত্তরও জানা গেছে অবশেষে। আসলে এংগস্ট্রম স্ক্যানডিয়া নামে একটি বীমা কোম্পানিতে কাজ করতেন। যে কারণে সে ‘স্ক্যানডিয়া ম্যান’ নামে পরিচিতি পায়। ঘটনার দিন সে দেরি করে কাজ করছিল। তার অফিসের সদর দপ্তর ছিল ঘটনাস্থলের খুবই কাছে।
প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে পুলিশ তাকে যখন জেরা করে, তখন এংগস্ট্রম খুনের ঘটনা সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিয়েছিল। এমনকি সে বলেছিল, প্রধানমন্ত্রী প্যালমেকে রিসাসিটেট করার চেষ্টা করেছিল। ২০১৭ সালে এংগস্ট্রমের সাবেক স্ত্রীকে জেরা করেছিল পুলিশ। তবে সে সময় তিনি মিথ্যা তথ্য দিয়ে বলেছিলেন এংগস্ট্রম পুরো নির্দোষ। আরো বলেছিলেন, সে খুবই ভীতু প্রকৃতির। মানুষ মারা দূরের কথা, সে একটা মাছিও মারবে না।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্যালমে হত্যাকাণ্ডের তদন্তে মিথ্যা তথ্যগুলি এতই জট পাকিয়ে দিয়েছিল যে সত্য উদঘাটন পিছিয়ে গিয়েছিল। হাজারো মানুষকে জেরা করেও খুনের কূলকিনারা করা যাচ্ছিল না। যে বুলেটটি উদ্ধার করা হয়েছিল সেটি দেখে পুলিশ এটুকু বুঝেছিল খুবই শক্তিশালী আগ্নেয়াস্ত্র থেকে ওই গুলি ছোঁড়া হয়।
একজন পুলিশ কর্মকর্তার মন্তব্য ছিল, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বুলেটপ্রুফ ভেস্ট পরে থাকলেও মারা যেতেন। কাজেই যে তাকে গুলি করেছিল, সে শুধু সুযোগ নিতে চায়নি, সে আসলেই পরিকল্পনা করে হত্যার উদ্দেশ্যেই গুলি চালিয়েছিল।
খুনের পেছনে রাজনৈতিক আরো কারণ ছিল বলা যায়। বিতর্কিত এবং স্পষ্টবক্তা উলফ প্যালমে তখন দ্বিতীয় মেয়াদে সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু যতটা সম্ভব সাধারণ মানুষের মতো থাকতে পছন্দ করতেন। প্রায়ই বাইরে বের হওয়ার সময় পুলিশি নিরাপত্তা নিতে অপছন্দ করতেন। ঘটনার রাতেও তিনি কোনো পুলিশ বা রক্ষী নেননি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বাসায় ফিরে নিরাপত্তা রক্ষীদের বিদায় দিয়েছিলেন। স্ত্রী লিসবেট সিনেমা দেখতে যাবার কথা বলেন।
আরো কিছু কারণ তো ছিলই। কেননা, প্যালমে ছিলেন খুবই আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী। সুইডেনের সোসাল ডেমোক্রাটিক পার্টির নেতা। বহু আন্তর্জাতিক বিষয়ে ছিলেন স্পষ্টবক্তা। দেশের ভেতর তার সংস্কার কর্মসূচি ব্যবসায়ী মহলে তাকে অজনপ্রিয় করেছিল। তারা তার পদক্ষেপে ক্ষুব্ধ ছিল। তিনি পারমাণকি শক্তির বিরুদ্ধেও কথা বলতেন। তিনি ১৯৬৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের চেকোশ্লোভাকিয়া দখলের সমালোচক ছিলেন। উত্তর ভিয়েতনামে আমেরিকার বোমা হামলা এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় ‘ন্যাক্কারজনক’ বর্ণবাদী সরকারের তিনি তীব্র সমালোচনা করতেন।